আক্তারুল ইসলাম।
বাংলাদেশের প্রকৃতি যেমন বৈচিত্র্যময়, তেমনি অনন্য তার ঋতুচক্র। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত—এই ছয় ঋতুর পালাবদলেই বাঙালির জীবনযাত্রা গড়ে উঠেছে রঙিন ও বৈচিত্র্যময় ছন্দে। বিশ্বের অনেক দেশেই বছরে চার ঋতু দেখা যায়, কিন্তু বাংলাদেশে ছয় ঋতুর আবর্তন আমাদের প্রকৃতিকে দিয়েছে ভিন্নতর সৌন্দর্য।
আজ ভাদ্রের প্রথম দিন। বর্ষার ভেজা পর্দা সরিয়ে এলো শরৎ—সৌন্দর্য, স্নিগ্ধতা ও শুভ্রতার ঋতু। পঞ্জিকা অনুযায়ী আগস্টের মাঝামাঝি থেকে অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়কাল জুড়েই শরৎকাল বিস্তার লাভ করে।
বর্ষার বিদায়, শরতের আগমন আষাঢ়-শ্রাবণের টানা বৃষ্টির পর আকাশ যেন নতুন রূপে আত্মপ্রকাশ করে শরতের প্রারম্ভে। অঝোর ধারার দিন ফুরিয়ে গেলে প্রকৃতি হয়ে ওঠে শুভ্র, উজ্জ্বল ও প্রাণময়। মাঠ-ঘাট সবুজে ভরে ওঠে, বাতাসে ভেসে আসে নতুন ধানের মঞ্জরির গন্ধ। দূরের মাঠে বাতাসে দুলতে থাকা কাশফুল যেন বাঙালির হৃদয় ছুঁয়ে যায়।
শরতের নাম উচ্চারণ করলেই চোখে ভেসে ওঠে সাদা কাশফুলে আচ্ছাদিত মাঠ। ভোরবেলায় শিশিরভেজা শিউলি গাছের নিচে বিছিয়ে থাকে সাদা-কমলা ফুলের ছড়াছড়ি। শিউলির ঘ্রাণে ভোরের বাতাস হয়ে ওঠে নির্মল ও স্নিগ্ধ।
বাংলার গ্রাম-গঞ্জে এখনও দেখা যায়, শিশুরা দল বেঁধে কাশবনে খেলতে যায়। অনেক পরিবার সকালে শিউলি কুড়িয়ে তৈরি করে মালা। এসব দৃশ্য গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে শরতের বন্ধনকে করে আরও নিবিড়।
রতের আকাশ অন্য সব ঋতুর চেয়ে আলাদা। গাঢ় নীল আকাশে সাদা তুলোর মতো মেঘ ভেসে বেড়ায়। কখনও ঝরঝরে বৃষ্টি এলেও দ্রুতই আকাশ পরিষ্কার হয়ে যায়। সূর্যের আলোতে প্রকৃতি ঝলমল করে ওঠে।
এই নির্মল নীল আকাশই কবিদের অনুপ্রেরণা হয়ে এসেছে যুগে যুগে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাশসহ অসংখ্য কবি শরতের আকাশ ও প্রকৃতিকে তাঁদের সৃষ্টিতে অমর করে তুলেছেন।
বাংলা সাহিত্যে শরতের বিশেষ স্থান রয়েছে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কবিতা ও গানে শরৎকে চিত্রিত করেছেন অপার ভালোবাসায়। তাঁর কলমে শরৎ এসেছে কাশ, শিউলি ও নতুন ধানের মঞ্জরির রূপে। শরৎকাল শুধু কবিতার বিষয় নয়, বরং ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কৃতির সঙ্গেও ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।
শরৎকাল মানেই বাঙালির উৎসবের মৌসুম। হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয় এই ঋতুতেই। গ্রাম থেকে শহর সর্বত্র সৃষ্টি করে এক বিশেষ আবহ।
অন্যদিকে কৃষকরা এ সময় ব্যস্ত থাকেন নতুন ধানের ক্ষেতে। শরতের শিশিরভেজা প্রভাত তাদের মনে জাগায় ফসলের প্রাচুর্যের আশা।
আকাশে সাদা চাঁদ ও তার স্নিগ্ধ আলো বাংলার রাত্রিকে সাজিয়ে তোলে অন্যরকম আবহে। নদীর জলে প্রতিফলিত চাঁদের আলো গ্রামীণ জীবনে রোমান্টিকতা যোগ করে। কবিগুরু থেকে জীবনানন্দ—অসংখ্য কবির কলমে এই জ্যোৎস্নার সৌন্দর্য অমর হয়ে আছে।
শরতের আবেদন কেবল গ্রামীণ জীবনে সীমাবদ্ধ নয়। নগর জীবনেও শরতের কাশবন এখন মানুষের কাছে আকর্ষণের জায়গা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কাশফুলের ছবি ভাইরাল হয়, তরুণ-তরুণীরা ছুটে যায় নদীর ধারে বা মাঠে শরতের রূপ দেখতে।
টেলিভিশন নাটক, সিনেমা বা বিজ্ঞাপনচিত্রেও বারবার উঠে আসে শরতের কাশবনের দৃশ্য।
তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শরতের স্বাভাবিক রূপ কিছুটা বদলে যাচ্ছে। ভাদ্র-আশ্বিন মাসেও টানা বৃষ্টি কিংবা কখনও খরা দেখা দেয়। পরিবেশবিদরা বলছেন, প্রকৃতির এ ভারসাম্যহীনতা দীর্ঘমেয়াদে শরতের আবহও নষ্ট করতে পারে।
সবকিছু মিলিয়েই শরৎ বাংলার মানুষের হৃদয়ে এক চিরন্তন আবেগের নাম। প্রকৃতি, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ধর্মীয় উৎসব কিংবা কৃষিজীবন—সবখানেই শরতের ছোঁয়া স্পষ্ট। শুভ্রতার প্রতীক এই ঋতু নতুন উদ্দীপনা ও নতুন আশায় ভরে দেয় বাঙালির মন।
আজ শরতের প্রথম দিনে তাই সাদা কাশফুল, শিউলির সুগন্ধ, নীল আকাশ আর জ্যোৎস্নার আলোকছটা মিলিয়ে বাংলার প্রকৃতি ও মানুষ হয়ে উঠুক আরও স্নিগ্ধ, আরও প্রাণময়।