সম্পাদকীয়
জিঘাংসা, অর্থাৎ প্রতিশোধ স্পৃহা বা প্রতিহিংসা, মানব চরিত্রের একটি নেতিবাচক দিক যা ব্যক্তি, সমাজ ও জাতিকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেয়। বর্তমান বিশ্বের নানা প্রান্তে হিংসা ও ঘৃণার আগুনে মানুষ মানুষকে হত্যা করছে, সমাজে অস্থিরতা ও নিরাপত্তাহীনতা ছড়িয়ে পড়ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ইসলাম কী বলে? ইসলাম কি প্রতিশোধের অনুমোদন দেয়, না কি সে এর বিপরীতে শান্তি ও ক্ষমার পথ দেখায়?
ইসলাম একটি শান্তিপূর্ণ জীবনব্যবস্থার নাম। কুরআন ও হাদিসে জিঘাংসা নয়, বরং ক্ষমা, সহনশীলতা ও ন্যায়বিচারের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “আর তোমরা মন্দের প্রতিদান দিও না মন্দ দিয়ে, বরং উত্তম পন্থায় তা প্রতিহত করো। তখন দেখবে, যার সঙ্গে শত্রুতা ছিল, সে হয়ে গেছে অন্তরঙ্গ বন্ধু।” (সূরা ফুসসিলাত: ৩৪)
পবিত্র কুরআন মানুষকে প্রতিশোধ না নিয়ে ধৈর্য ধরতে এবং আল্লাহর ন্যায়বিচারের ওপর ভরসা রাখতে উদ্বুদ্ধ করে। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনে আমরা এক অনন্য উদাহরণ দেখি, যেখানে তিনি তাঁকে কষ্টদাতা শত্রুকেও ক্ষমা করেছেন। তায়েফবাসীদের হাতে পাথর খেয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় ফেরেশতা তাঁকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, চাইলে তিনি তাদের ধ্বংস করে দিতে পারেন। কিন্তু তিনি বলেছিলেন, “আমি আশা করি, তাদের পরবর্তী প্রজন্ম আল্লাহর একত্বে ঈমান আনবে।”
ইসলাম অবশ্য ন্যায়বিচারের পক্ষেও সমর্থন দেয়। অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো ফরজ, তবে সেটি হতে হবে আইনানুগভাবে, অহিংস পথে। ব্যক্তি ইচ্ছেমতো প্রতিশোধ নিতে পারে না। বিচার এবং শাস্তি রাষ্ট্রের অধিকার, ব্যক্তির নয়। জিঘাংসা চরিতার্থ করতে গিয়ে যে কেউ যদি আরেকজনকে ক্ষতি করে, সে নিজেই ইসলামের সীমা লঙ্ঘন করে। আল্লাহ বলেন, “তোমরা সীমা লঙ্ঘন করো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করেন না।” (সূরা বাকারা: ১৯০)
জিঘাংসা চরিতার্থ করার মাধ্যমে কেউ সাময়িক স্বস্তি পেলেও, সমাজে এটি একটি চক্র তৈরি করে—ঘৃণা, হিংসা, হত্যা—যার পরিণতি চরম দুর্ভোগ। ইসলাম সেই চক্র ভাঙতে বলে। সে বলে, ক্ষমাই সর্বোচ্চ শক্তি। মানবিকতা, সহানুভূতি ও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যদি কেউ ক্ষমা করতে পারে, সে-ই প্রকৃত বিজয়ী।
অতএব, ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে জিঘাংসা চরিতার্থ করা নয়, বরং ন্যায়ের পথে ধৈর্য ও ক্ষমার চর্চাই সমাজ গঠনে গঠনমূলক ভূমিকা রাখে। মানব ক্ষতি নয়, মানব কল্যাণই হোক আমাদের পথ ও প্রেরণা।