মো: রফিকুল ইসলাম।
দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে পাক-ভারত সম্পর্ক সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল। এই দুই পরমাণু শক্তিধর প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে একাধিকবার সরাসরি যুদ্ধ, সীমান্ত সংঘর্ষ, কূটনৈতিক উত্তেজনা ও নিরব শীতল যুদ্ধ হয়েছে। পাকিস্তান ও ভারতের সম্পর্কের এই টানাপোড়েন শুধু দুই দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে নয়, বরং পুরো অঞ্চলের নিরাপত্তা, অর্থনীতি এবং মানবিক পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করেছে। এই কলামে আমরা এই যুদ্ধ এবং এর প্রভাব আঞ্চলিক শান্তি ও অশান্তির প্রেক্ষাপটে আলোচনা করব।
ইতিহাসের পাতা থেকে
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারত বিভক্ত হওয়ার পর থেকেই পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক শত্রুতা দিয়ে শুরু হয়। কাশ্মীর নিয়ে প্রথম যুদ্ধ (১৯৪৭-৪৮), এরপর ১৯৬৫ সালের পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ এবং ১৯৭১ সালের যুদ্ধ—যার ফলে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হয়ে বাংলাদেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে—এইসব যুদ্ধ দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী অবিশ্বাস ও বৈরিতা তৈরি করে। এরপর ১৯৯৯ সালে কারগিল যুদ্ধ এবং মাঝে মাঝে সীমান্তে গোলাগুলির ঘটনা সেই দ্বন্দ্বকে আরও গভীর করেছে।
যুদ্ধের প্রভাব: শুধু সীমান্তে নয়
পাক-ভারত যুদ্ধ শুধু দুই দেশের সীমান্তে সংঘর্ষে সীমাবদ্ধ থাকে না। এর প্রভাব পড়ে গোটা অঞ্চলের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে। যুদ্ধের সময় বা যুদ্ধোন্মুখ পরিস্থিতিতে সাউথ এশিয়া রিজিওনের বিনিয়োগকারীরা নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে পিছিয়ে আসে, বাণিজ্য ব্যাহত হয় এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলো বরাদ্দ হারায় সামরিক ব্যয়ের কাছে।
শান্তি প্রক্রিয়া: সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ
অবশ্যই যুদ্ধ সবসময় চূড়ান্ত সমাধান হতে পারে না। ভারত ও পাকিস্তান কয়েকবার শান্তি আলোচনায় বসেছে—লাহোর চুক্তি (১৯৯৯), আগরা সামিট (২০০১), এবং ট্র্যাক টু ডিপ্লোম্যাসি ইত্যাদি তার উদাহরণ। তবে সন্ত্রাসবাদ, কাশ্মীর ইস্যু, পানি বণ্টনসহ বিভিন্ন বিরোধী ইস্যু এই প্রক্রিয়াকে বারবার ব্যাহত করেছে। ২০১৬ সালে উরি হামলা ও ২০১৯ সালের পুলওয়ামা ঘটনার পর ভারতের ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ এবং ‘বালাকোট অ্যাটাক’ দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ককে আরও তলানিতে নিয়ে যায়।
জনগণের আকাঙ্ক্ষা ও আঞ্চলিক সংহতি
যুদ্ধ কোনো দেশের সাধারণ মানুষের জন্য কাম্য নয়। উভয় দেশের নাগরিকেরা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পক্ষেই। দুই দেশের সাংস্কৃতিক মিল, ভাষাগত ঘনিষ্ঠতা এবং ইতিহাসের সংযুক্তি একে অপরের প্রতি মানবিক সহানুভূতি তৈরি করতে পারে। আঞ্চলিক সংহতির জন্য সার্ক (SAARC) একটি সম্ভাবনাময় প্ল্যাটফর্ম হলেও পাক-ভারত দ্বন্দ্বের কারণে সেটি কার্যত অচল।
উপসংহার
পাক-ভারত যুদ্ধ শুধু সামরিক দ্বন্দ্ব নয়, এটি একটি দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক ও কৌশলগত দ্বন্দ্বের প্রতিফলন। শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে উভয় দেশকে কূটনৈতিক সংযম, পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখাতে হবে। আঞ্চলিক অগ্রগতি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হলে যুদ্ধ নয়, বরং সংলাপ ও সহযোগিতাই হতে পারে একমাত্র পথ।
শান্তি যেন প্রতিযোগিতা নয়, বরং অভিন্ন আকাঙ্ক্ষা হয়ে উঠে—এই হোক দক্ষিণ এশিয়ার লক্ষ্য।