
কক্সবাজার প্রতিনিধি।
পরিবেশ সংরক্ষণের সব আইন-কানুনকে মাটিতে মিশিয়ে, আদালতের নিষেধাজ্ঞাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কক্সবাজারের মহেশখালীর সোনাদিয়া দ্বীপে চলছে প্যারাবন ধ্বংসের উন্মাদনা। পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে ধ্বংস করা হয়েছে হাজার হাজার কেওড়া ও বাইনগাছ। জনসমক্ষে বনাঞ্চল জ্বালিয়ে তৈরি হয়েছে একের পর এক চিংড়িঘের। যেন কারও কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই।
জানা গেছে, ২০০৬ সালে সরকার এই দ্বীপকে ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ (ইসিএ) ঘোষণা করলেও, সেই ঘোষণার এখন কোনো মূল্য নেই। বন বিভাগ ও পরিবেশ অধিদপ্তর যেন নির্বাক দর্শক। গত কয়েক মাসে প্রায় এক হাজার একর প্যারাবন উজাড় করে গড়ে তোলা হয়েছে সাতটি নতুন চিংড়িঘের, যার ভেতর বহু ঘের পরিচালিত হচ্ছে স্থানীয় রাজনৈতিক গডফাদারদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে।
তিনটি পয়েন্টে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, পুড়ে ছাই হয়ে গেছে বনাঞ্চল। আগুনে পোড়া গাছের কঙ্কাল এখনো মাটিতে পড়ে আছে। বন বিভাগের তথ্য মতে, অন্তত এক লাখের বেশি গাছ ধ্বংস হয়েছে, যেগুলোর মধ্যে ছিল পাখি, কাঁকড়া, কাছিম ও বিরল সামুদ্রিক প্রাণীর আশ্রয়স্থল।
গত বছরের ২৩ অক্টোবর উচ্চ আদালত অবৈধ চিংড়িঘের উচ্ছেদ ও প্যারাবন ধ্বংস বন্ধে নির্দেশ দিলেও, ছয় মাসেও কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। বরং ঘেরের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৪-এ। এর মধ্যে অন্তত ৩৭টি তৈরি হয়েছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে, আর সাম্প্রতিকগুলো বানাচ্ছেন বিএনপি-সমর্থিত প্রভাবশালীরা।
বন বিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা আক্ষেপ করে বলেন, সশস্ত্র পাহারায় বন দখল হচ্ছে। বনকর্মীরা কয়েকটি বাঁধ কাটলেও মূল দখলদারদের বিরুদ্ধে কার্যকর অভিযান নেই। কারণ সবার জানা- ঘেরের টাকা ওপরে পর্যন্ত পৌঁছায়। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান, বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতারা পরস্পরকে দোষারোপ করলেও, মূল সত্য হচ্ছে- পক্ষ বদলায়, দখলদারি থেকে যায়।
২০০৭ সালে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষকে (বেজা) দেওয়া হয়েছিল ৯ হাজার একর বনভূমি ইকো-ট্যুরিজম গড়ার জন্য। কিন্তু ১৭ বছরেও গড়ে ওঠেনি একটি প্রকল্পও। বরং সেই ভূমি এখন দখলদারদের দখলে।
পরিবেশ সংগঠন ‘ধরা’র সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, “ঘেরের চিংড়ি আর লবণের টাকায় সবাই খুশি- প্রশাসন থেকে স্থানীয় রাজনীতিক, কেউই এর বাইরে নয়। তাই আদালতের নির্দেশও উপেক্ষিত থেকে যায়।”
সোনাদিয়া ধ্বংস হচ্ছে আমাদের চোখের সামনে। বন, জীববৈচিত্র্য, মাটি ও পানি- সব ধ্বংস করে চলছে গুটি কয়েক লোকের লোভের খেলা। প্রশাসনের নীরবতা, রাজনৈতিক প্রভাব এবং আইনকে পাশ কাটিয়ে গড়ে ওঠা এই অপরাধ সাম্রাজ্যকে এখনই না থামানো গেলে, হারিয়ে যাবে বাংলাদেশের এক অমূল্য প্রাকৃতিক রত্ন।