
গত এক দশকে ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ইলন মাস্ক—উভয়ই আমেরিকার রাজনীতি ও প্রযুক্তি জগতের অন্যতম আলোচিত চরিত্র হয়ে উঠেছেন। একজন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট, অন্যজন বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ও টেসলা, স্পেসএক্স এবং X (পূর্বে টুইটার)-এর মালিক। শুরুতে দুজনের মধ্যে একধরনের পারস্পরিক শ্রদ্ধা থাকলেও সময়ের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক তিক্ততায় রূপ নিয়েছে। এই বৈরী সম্পর্ক কেবল ব্যক্তিগত স্তরেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং এর অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাবও যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে।
সম্পর্কের সূচনা ও ক্রমাবনতি
ইলন মাস্ক ট্রাম্পের প্রশাসনের শুরুর দিকে নীতি-পরামর্শক কাউন্সিলে ছিলেন এবং পরিবেশ, প্রযুক্তি ও ব্যবসায়িক নীতিনির্ধারণে পরোক্ষভাবে প্রভাব ফেলতেন। কিন্তু ট্রাম্পের প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তের পর মাস্ক প্রতিবাদস্বরূপ সেই কমিটি থেকে পদত্যাগ করেন। সেখান থেকেই সম্পর্কের অবনতি শুরু।
পরবর্তী সময়ে, ট্রাম্প মাস্ককে ‘অতিভোজনকারী ধনকুবের’ এবং ‘অবিশ্বস্ত’ বলে কটাক্ষ করেছেন। অন্যদিকে, মাস্কও ট্রাম্পের ভুয়া খবর ছড়ানোর প্রবণতা, গণতন্ত্রের প্রতি অশ্রদ্ধা ও সামাজিক মাধ্যমে উত্তেজনা ছড়ানোর প্রবণতার সমালোচনা করেছেন।
অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গিতে দ্বন্দ্ব
ট্রাম্পের বাণিজ্যনীতি ছিল রক্ষণশীল ও “আমেরিকা ফার্স্ট” ভিত্তিক। বিপরীতে, মাস্কের দৃষ্টিভঙ্গি হলো উদ্ভাবন ও বৈশ্বিক বিস্তারের উপর নির্ভরশীল। ট্রাম্পের আমলে চিনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধে টেসলার উৎপাদন ও সরবরাহ চেইনে বিঘ্ন ঘটে। যদিও মাস্ক সেই সময়ে চীনে কারখানা খুলে স্মার্ট কৌশল নেন, কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে তার মনোমালিন্য প্রকট হয়ে ওঠে।
একইভাবে, মাস্কের মালিকানাধীন টুইটার (বর্তমানে X)-এর উপর ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞা—বিশেষ করে ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হামলার পর—একটি বিতর্কের জন্ম দেয়। পরবর্তীতে মাস্ক ট্রাম্পকে পুনরায় X-এ ফিরতে আহ্বান জানালেও, ট্রাম্প তার নিজস্ব Truth Social প্ল্যাটফর্মে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। এটা আবার ইঙ্গিত দেয় যে তাদের মতাদর্শগত ও কৌশলগত পার্থক্য কতটা গভীর।
বাজারে প্রভাব ও বিনিয়োগ প্রবণতা
তাদের এই দ্বন্দ্ব অনেক সময় বিনিয়োগকারীদের মনস্তত্ত্বে প্রভাব ফেলে। ট্রাম্পের সম্ভাব্য নীতির বিপরীতে মাস্কের কোম্পানিগুলোর শেয়ার মূল্যে ওঠানামা দেখা গেছে। উদাহরণস্বরূপ, পুনরায় ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট প্রার্থিতার ঘোষণার পরে Tesla ও SpaceX সংক্রান্ত খাতে নিয়ন্ত্রণ ও করনীতির সম্ভাব্য পরিবর্তনের আশঙ্কায় বিনিয়োগকারীরা সতর্কতা অবলম্বন করেন।
এছাড়া প্রযুক্তি ও সামাজিক মিডিয়া খাতে মাস্কের স্বাধীনতামূলক নীতিমালা ও ট্রাম্পের নজরদারি ও সেন্সরশিপে বিশ্বাস—এই দ্বৈরথ দীর্ঘমেয়াদে মার্কিন উদ্ভাবনী সংস্কৃতিতে দ্বিধা ও বিভাজন তৈরি করতে পারে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও রাজনৈতিক প্রভাব
২০২৪ ও ২০২৮ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে ঘিরে এই সম্পর্ক আরও নাটকীয় রূপ নিতে পারে। মাস্ক যদি ওপেনলি ট্রাম্প-বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেন, তবে রিপাবলিকান পার্টির সঙ্গে তার সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। আবার যদি ট্রাম্প পুনর্নির্বাচিত হন, তবে মাস্কের ব্যবসায়িক জগতে সরকারি চাপ ও বিধিনিষেধের আশঙ্কা তৈরি হবে।
উপসংহার
ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইলন মাস্কের এই বৈরী সম্পর্ক দুইটি ভিন্ন জগতের সংঘর্ষকেই উপস্থাপন করে—একটি রাজনীতি, অপরটি প্রযুক্তিনির্ভর উদ্যোক্তা মনোভাব। এই দ্বন্দ্ব কেবল ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমিত নয়; বরং এটি ভবিষ্যৎ প্রযুক্তি নীতি, বাণিজ্য পরিবেশ এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতার উপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। দেশ ও সমাজের বৃহত্তর স্বার্থে এমন মতানৈক্য যদি রচনাশীল বিতর্কে পরিণত হয়, তবে তা হতে পারে ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা। অন্যথায়, এটি হতে পারে বিভাজনের আরেক দৃষ্টান্ত।