
চট্টগ্রাম প্রতিনিধি।
আসন্ন জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ইসলামিক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতা করে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার প্রক্রিয়া চলছে বলে জানিয়েছেন জামায়াতে ইসলামির সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার।
শুক্রবার (১৩ জুন) চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় সর্বস্তরের দায়িত্বশীলদের সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব করে বলে।
মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, সরকার যখন এপ্রিলে নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখ ঘোষণা করেছে, আমরা আশা করি জনগণের আকাঙ্ক্ষায় সমস্ত সংস্কারমূলক কাজ, মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার—এসব সুষ্ঠুভাবে করার জন্য, ন্যূনতম যতটুকু সময় সরকারের প্রয়োজন হয়, সরকার তো সেসব বিবেচনা করেই সময়টা ঠিক করেছে, নাকি? খুব তাড়াহুড়ো করে করতে গেলে যদি সরকার বিচার ও সংস্কারের কাজটা পরিপূর্ণভাবে এবং দৃষ্টান্তমূলকভাবে করতে না পারে, তাহলে কিন্তু আমাদের সেই স্বপ্নের বাংলাদেশ বিনির্মাণ করা হবে না।
‘আমি মনে করি, বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক দলের জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে, সরকারের ঘোষিত নির্বাচন রোডম্যাপকে মেনে নিয়ে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সকলের অংশগ্রহণ প্রয়োজন। গণতন্ত্র চর্চার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে সম্পর্ক, সহমর্মিতা, হাতে হাত ধরে চলা দরকার, তা হওয়া উচিত।’
তিনি বলেন, আওয়ামী ফ্যাসিবাদ ও দুঃশাসনকে যারা আবার ফিরিয়ে আনতে চায়, তাদেরকে ঠেকিয়ে দিয়ে আমাদের ২০০০ শহীদ ও ২০ হাজার আহতের স্বপ্নের বাংলাদেশ বিনির্মাণে সকলকে মিলে যেন তাদের সহযোগিতা করতে পারি। এজন্য সরকারকে সহযোগিতা করা উচিত।
রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, সকল রাজনৈতিক দলের কাছে আমাদের আবেদন থাকবে—দলের চেয়ে দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের যে বহুদলীয় গণতন্ত্র সূচনা করেছিলেন আওয়ামী লীগের শাসনের পর, তিনি এই কথাটা বারবার বলতেন—দলের চেয়ে দেশ বড়। একথা আমাদের মনে রাখতে হবে। আমরা যেন নিজের দলীয় স্বার্থের জন্য এমন দিকে না যাই যাতে দেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়। কারণ সরকার যে সমস্ত সংস্কারকাজে হাত দিয়েছে, কিছু সংস্কার না করে যদি নির্বাচন হয়ে যায়, তাহলে সে নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া এবং তারপর যারাই ক্ষমতায় আসুক, তাদের পক্ষে রাষ্ট্র কাঠামোকে নতুন করে গঠন করে ফ্যাসিবাদের জন্মের রাস্তা থেকে সরিয়ে, মানবিক ও সমৃদ্ধ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব হবে না।
‘একটা নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে, দলীয় প্রভাবমুক্ত হয়ে, রাষ্ট্রের সাংবিধানিক কাঠামোকে কোনো দলীয় স্বার্থের দিকে না তাকিয়ে পুনর্বিকাশ করা সম্ভব। দলীয় সরকার আসলে সে শুধু তার দলের স্বার্থই দেখে।’
পরওয়া বলেন, রাষ্ট্রের কাঠামোটাকে এমনভাবে মেরামত করতে হবে যাতে যারাই ক্ষমতায় আসুক, তারা সেখানে ফ্যাসিবাদী আচরণের কোনো সুযোগ না পায়। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে ধারণ করে, জনগণের আকাঙ্ক্ষার মূল্য দিয়ে তারা যেন দেশকে পরিচালনা করতে পারে—এমন প্রয়োজনীয় সংস্কার তো করা দরকার। এইটুকু সময় না দিলে, অন্তর্বর্তী সরকার ব্যর্থ হয়ে গেলে, এসব গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার ছাড়া যদি কোনো দল ক্ষমতায় আসে, তারা যতই ওয়াদা করুক না কেন, দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে তারা এ সংস্কার করতে পারবে না।
আওয়ামী লীগের বিচারের দাবি জানিয়ে বলেন, নির্বাচনে নির্ধারিত রোডম্যাপে আমরা সকলের সহযোগিতা করতে রাজি আছি। সেই সাথে আরেকটি কাজ গুরুত্বপূর্ণ—যারা এত লোকের জীবন নিল, যারা ১৭ বছর মানুষের স্বাধীনতা, ভোটাধিকার কেড়ে নিল—তাদের বিচার হতে হবে। সেই বিচারের জন্য দুটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে। সে বিচার শেষ হতে কিছুটা সময় প্রয়োজন।
নির্বাচন আয়োজনে সরকারকে সহযোগিতার তাগিদ তিনি আরও বলেন, দিয়ে ঘোষিত রোডম্যাপ অনুযায়ী নির্বাচনের জন্য আমাদের সকলের সহযোগিতা করা উচিত, অংশগ্রহণ করা উচিত। আমরা আশা করি ঘোষিত সময়ের মধ্যে কমপক্ষে বিচারগুলো দৃশ্যমান হবে এবং প্রয়োজনীয় মৌলিক সংস্কারগুলো শেষ করে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
স্থানীয় নির্বাচনের দাবি তুলে ধরে জামায়াতের এই নেতা বলেন, একটা দাবি আমরা বলেছি—চাইলে সেটা এখনো সম্ভব। আমরা বলেছি, স্থানীয় নির্বাচনগুলো না হওয়ায় স্থানীয় সরকারে অনেক অনিয়ম, দুর্নীতি, অপরাধ বাসা বেঁধেছে। পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনের কাজগুলো বিকৃত হচ্ছে স্থানীয় সরকার নির্বাচন না হওয়ায়। আমরা মনে করি, সেই নির্বাচনও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠানের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে হওয়া উচিত।
‘আমরা একটা স্বাধীন দেশ পেয়েছি, একটি ভূখণ্ড পেয়েছি, মানচিত্র পেয়েছি, জাতীয় পতাকা আছে, সংগীত আছে—এটাই শুধু স্বাধীনতা নয়। এই দেশের জনগণকে, দেশ পরিচালনা করা, অর্থনীতি, রাজনীতি, ধর্মীয় মূল্যবোধ, জাতিসত্তা—কীভাবে চলবে সেটা একটি সরকার ঠিক করবে। কিন্তু গত ১৭ বছর তা হয়নি।’
জামায়াতে সেক্রেটারি বলেন, আমাদের রাজনীতি, আমাদের ভোট কখন হবে আর কে যাবে—সেটি দিল্লি ঠিক করে দিয়েছে। অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য—সবকিছু বিদেশ থেকে ঠিক করা হচ্ছে। তিনটা ভোট হয়ে গেল, দেশের জনগণ ভোট দিতে পারল না। আগামী জাতীয় নির্বাচনে এমন একটি শক্তিশালী সরকার, এমন শক্তিশালী জন প্রতিনিধি দিয়ে পার্লামেন্ট গঠন করব, যে পার্লামেন্ট দিল্লির তাবেদারি না করে, মাথা উঁচু করে জন আকাঙ্ক্ষা পূরণ করে দেশ পরিচালনা করবে। জামায়াতে ইসলামি সেই নির্বাচনে প্রতিটি আসনের জন্য প্রার্থী প্রস্তুত করেছে।
‘নির্বাচন কাছে আসলে রাজনীতির অনেক মেরুকরণ হয়, বিভিন্ন দল, জোট, সমঝোতার রাজনীতি শুরু হয়। আমরা আশা করছি নতুন কোনো ফ্যাসিবাদের জন্ম না হোক, এদেশে আমাদের আদর্শ ও মূল্যবোধ ধ্বংস করতে না পারে।’
পরওয়ার বলেন, সেজন্য বিভিন্ন দেশপ্রেমিক ইসলামিক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা করে একটি বৃহত্তর ঐক্যে নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে ইনশাআল্লাহ। দেশপ্রেমের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য, জুলাই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাকে ধরে রাখার জন্য, জাতীয় ঐক্য রক্ষার জন্য—যেকোনো দলের সঙ্গে ঐক্য গড়তে হলে জামায়াতে ইসলামি তাতে রাজি আছে। সেসব দলের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ আলোচনা ও মতবিনিময় চলছে। আমরা আশা করি ঐক্য হয়ে যাবে, ইসলামিক অনেক দলের সঙ্গে আলোচনা চলছে।
এমপি প্রার্থীর নাম ঘোষণায় তিনি বলেন, চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া- লোহাগাড়া) আসনের আগামী পার্লামেন্ট নির্বাচনের জন্য আলহাজ্ব শাহজাহান চৌধুরীকে মনোনীত করা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় মজলিশে শুরার সদস্য ও চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার আমীর জননেতা আনোয়ারুল আলম চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম, মুহাম্মদ শাহজাহান, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য জননেতা ও চট্টগ্রাম মহানগরী আমীর জননেতা আলহাজ্ব শাহজাহান চৌধুরী, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য অধ্যাপক আহসান উল্লাহ ভুঁইয়া, কেন্দ্রীয় মজলিশে শুরার সদস্য ও চট্টগ্রাম অঞ্চল টীম সদস্য অধ্যাপক জাফর সাদেক, শ্রমিক কল্যাণের কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি মুহাম্মদ ইসহাক।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে জনাব মাওলানা আব্দুল হালিম বলেন, এ আসনের বৈঠকের জন্য আমীরে জামায়াত মকবুল আহমদ সাহেব ও গ্রেফতার হয়েছে। জাতির স্বার্থে, দ্বীনের স্বার্থে ও সমঝোতার স্বার্থে বিভিন্ন জায়গায় আমাদের প্রার্থী পরিবর্তন হতে পারে। সেজন্য আমীরে জামায়াত নিজের আসনও জাতির স্বার্থে ছেড়ে দিতে পারেন বলে ঘোষণা করেছেন। বৈঠকে সব শুনে ময়দানে গিয়ে বিপরীত দিকে চলা ইসলামের সৌন্দর্য নয়। আমাদের কয়েকজন সেটা নিজেদের চরিত্রে লালন করেছে। তাই আমাদের চিন্তা চেতনা সবসময় সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে থাকা দরকার। কোন অবস্থায় দ্বিমুখী আচরণ করা যাবে না। সত্যকে সত্য, ন্যায়কে ন্যায় ও অন্যায়কে অন্যায় হিসেবে ঘোষণা দেয়াই সর্বোত্তম জিহাদ। সারাদেশের জনশক্তিরা সাতকানিয়া লোহাগাড়ার কথা বললে অন্তর থেকে দোয়া করে। কিন্তু এ সংগঠনের জনশক্তিকে ঠিক সেভাবে নিজেদের মূল্যায়ন করে নিজেদের মানকে উন্নত করে ময়দানে ঝাপিয়ে পড়তে হবে। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে এ আসন সহ সকল আসনে বিজয় দান করবেন, ইনশাআল্লাহ।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে মুহাম্মদ শাহজাহান বলেন, এ আসনের জন্য সাবেক এমপি আলহাজ্ব শাহাজাহান চৌধুরী অনেক বেশি পরিচিত। এ আসনের অতীতের সকল ত্যাগের চেয়ে আরও বেশি ত্যাগ স্বীকার করে ইতিহাস সৃষ্টি করার জন্য একটি সুন্দর বিজয়ের রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে। এবারে আমাদের স্বপ্ন সম্ভাবনার বাংলাদেশ। এবারে আমাদের স্বপ্ন ফ্যাসিবাদের চূড়ান্ত পরাজয়। তাই সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে ময়দানে ঝাপিয়ে পড়তে হবে। ইনশাআল্লাহ, বিজয় আমাদের সুনিশ্চিত।
মহানগরী আমীর ও চট্টগ্রাম-১৫ আসনের মনোনীত প্রার্থী সাবেক এমপি আলহাজ্ব শাহজাহান চৌধুরী বলেন, আমি ইসলামী আন্দোলনের পূর্বসূরীদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি। আল্লাহ তাদের এ ত্যাগকে কবুল করুন। আমরা শহীদের এ ময়দানে সম্মিলিতভাবে কাজ করে দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে আল্লাহর সাহায্য কামনা করছি।
বিশেষ অতিথি অধ্যাপক আহসান উল্লাহ বলেন, আমলে সালেহ হিসেবে নিজেদের যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আগামী নির্বাচনে এই আসনের বিজয় নিশ্চিত করতে হবে। আপনারা আগে থেকে কাজ করে আসছেন, আজকে প্রার্থী পেয়েছি তাই নতুনভাবে আবার ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। ফ্যাসিস্ট হাসিনা ভারতের কাছে দেশকে বন্ধক রেখে আজ দেশকে তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিণত করেছে। আওয়ামীলীগ যেভাবে গণতন্ত্র ধ্বংস করেছে, এখন সংস্কার ছাড়া দেশে গণতন্ত্র ফিরে আনা অসম্ভব।
চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা সেক্রেটারি অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদরুল হকের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত সম্মেলনে আরও বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা নায়েবে আমীর অধ্যাপক মুহাম্মদ নুরুল্লাহ, ড. হেলাল উদ্দিন মুহাম্মদ নোমান, সহকারী সেক্রেটারি মুহাম্মদ জাকারিয়া, এডভোকেট মোহাম্মদ নাছের, সাংগঠনিক সেক্রেটারি মাওলানা নুরুল হোসাইন, জেলা কর্মপরিষদ সদস্য মাওলানা কামাল উদ্দীন, নুরুল হক, মাওলানা আবুল ফয়েজ, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা শিবিরের সভাপতি আসিফুল্লাহ মুহাম্মদ আরমান, লোহাগাড়া উপজেলা আমীর অধ্যাপক আসাদুল্লাহ ইসলামাবাদী ও সাতকানিয়া উপজেলা আমীর মাওলানা কামাল উদ্দিন, সাতকানিয়া পৌরসভার আমীর অধ্যক্ষ হামিদ উদ্দীন আজাদ প্রমুখ।