
সম্পাদকীয় :
সম্প্রতি সংঘটিত ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ কেবল মধ্যপ্রাচ্যকেই নয়, বরং গোটা বিশ্ব ব্যবস্থাকেই এক নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। বহু দশক ধরে জমে থাকা দ্বন্দ্ব, প্রক্সি যুদ্ধ এবং ভৌগোলিক আধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টা অবশেষে সরাসরি সংঘাতে রূপ নিয়েছে। যুদ্ধের পরবর্তী প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক রাজনীতি, জ্বালানি নিরাপত্তা, সামরিক মিত্রতা ও ধর্মীয় মেরুকরণ—সবকিছুতেই ব্যাপক পরিবর্তনের ইঙ্গিত মিলছে।
যুদ্ধের প্রকৃত রূপ ও তাৎপর্য
ইরান ও ইসরায়েল—উভয়ই এই অঞ্চলের শক্তিশালী রাষ্ট্র। দীর্ঘদিন ধরে তাদের মধ্যে ঠান্ডা যুদ্ধ চললেও এবার তা উন্মুক্ত রূপ নিয়েছে। সিরিয়া ও লেবাননে হিজবুল্লাহ, হামাসের প্রভাবে ইরানের কৌশলগত অবস্থান যেমন দৃঢ়, তেমনি ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের প্রত্যক্ষ সমর্থন নিয়ে একটি আধুনিক সামরিক ক্ষমতা গড়ে তুলেছে। তাই এই সংঘর্ষ কেবল দুই রাষ্ট্রের নয়—এটি আসলে একটি বৃহৎ ভূরাজনৈতিক শক্তির লড়াই।
বিশ্ব রাজনীতিতে পুনঃবিন্যাস
এই যুদ্ধের ফলে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন—সবাই নতুন করে তাদের পররাষ্ট্রনীতির কৌশল পুনর্বিন্যাসে বাধ্য হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের পাশে শক্তভাবে দাঁড়ালেও যুদ্ধের বিস্তার ঠেকাতে তার মধ্যপ্রাচ্য নীতিতে ভারসাম্য খোঁজার চেষ্টা চলছে। চীন, যিনি সম্প্রতি সৌদি-ইরান সম্পর্ক মীমাংসায় মধ্যস্থতা করেছে, এখন আরো সক্রিয়ভাবে এই অঞ্চলে তার কূটনৈতিক উপস্থিতি জোরদার করছে। রাশিয়া, ইউক্রেন যুদ্ধের ক্লান্তি নিয়ে, নতুন এক মধ্যপ্রাচ্য ফ্রন্টকে শক্তির ভারসাম্যে কাজে লাগাতে চায়।
তেলের বাজার ও বৈশ্বিক অর্থনীতি
এই যুদ্ধের সরাসরি প্রভাব পড়েছে জ্বালানি বাজারে। হরমুজ প্রণালীর নিরাপত্তা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেওয়ায় তেলের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। উন্নয়নশীল দেশগুলো, বিশেষত দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলো এই মূল্যবৃদ্ধির ফলে চরম চাপের মুখে পড়েছে। ইউরোপ, যারা রাশিয়ার বিকল্প হিসেবে মধ্যপ্রাচ্য থেকে গ্যাস-তেল আমদানির দিকে ঝুঁকছিল, তাদের জন্য এটি এক নতুন সংকট।
ইসলামী বিশ্বের বিভাজন ও আভ্যন্তরীণ টানাপোড়েন
এই যুদ্ধ একটি দুঃখজনক বাস্তবতা সামনে এনেছে—ইসলামী বিশ্ব বিভক্ত, বিচ্ছিন্ন ও দুর্বল। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ অনেক দেশ নিরপেক্ষ অবস্থান নিচ্ছে, কেউ কেউ আবার কূটনৈতিক নীরবতায় আচ্ছন্ন। মুসলিম জনগণ আবেগতাড়িত হলেও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কোন কার্যকর ঐক্য গড়ে ওঠেনি। এই পরিস্থিতি উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলোর জন্য সুযোগ সৃষ্টি করছে, যারা ধর্মীয় আবেগকে পুঁজি করে সহিংসতা উস্কে দিতে পারে।
দক্ষিণ এশিয়ার করণীয়
বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে এই যুদ্ধ পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অভ্যন্তরীণ শান্তি বজায় রাখার জন্য জ্বালানি বিকল্প, কূটনৈতিক ভারসাম্য ও ধর্মীয় সম্প্রীতির প্রশ্নে সুস্পষ্ট নীতি গ্রহণ সময়ের দাবি। এ অঞ্চলের মুসলিম জনসাধারণের আবেগকে সম্মান জানিয়ে দায়িত্বশীল কূটনৈতিক অবস্থান নেওয়া জরুরি।
—
উপসংহার:
ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ বিশ্বব্যবস্থার ভারসাম্যে এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁক রচনা করেছে। এটি কেবল একটি সামরিক সংঘর্ষ নয়, বরং ভূরাজনীতি, ধর্ম, অর্থনীতি এবং আন্তর্জাতিক নৈতিকতার এক জটিল পরীক্ষা। এই যুদ্ধের প্রকৃত শিক্ষা হচ্ছে—শান্তি কেবল অস্ত্রের ভারে আসে না, আসে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠায়, সম্মিলিত কূটনীতিতে এবং আস্থার পুনর্গঠনে।
বিশ্ব নেতৃত্ব আজ সেই দায় এড়াতে পারে না। আর দক্ষিণ এশিয়ার মত অঞ্চলগুলোর জন্য এটি কেবল দর্শকের ভূমিকা নয়—বরং ইতিহাসের এক সক্রিয় শরিক হওয়ার সময়।