
আন্তর্জাতিক ডেস্ক।
ইউক্রেনের সবাই একমত— পরিস্থিতি খারাপের দিকেই যাচ্ছে। কিয়েভের মানুষ, ইউক্রেনের অন্যান্য শহরের বাসিন্দাদের মতো অনেক কিছু সহ্য করেছেন। তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে যুদ্ধের উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে তারা কঠিন হয়ে উঠেছেন, তৈরি করেছেন অদম্য সহনশক্তি।
কিন্তু সাম্প্রতিক মাসগুলোতে তারা নতুন এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছেন— আকাশ থেকে একযোগে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, কখনো একক কোনো শহরের ওপর শত শত আক্রমণ। গত রাতেও লক্ষ্যবস্তু ছিল কিয়েভ। এর আগের সপ্তাহেও। মাঝখানে হামলা হয়েছিল পশ্চিম দিকের শহর লুতস্কে।
তিন বছর আগে ইরান থেকে আসা শাহেদ ড্রোন ছিল এক নতুন অভিজ্ঞতা। ২০২২ সালের অক্টোবরে দক্ষিণের জাপোরিঝিয়ায় আকাশে প্রথমবার এই ড্রোনের গুঞ্জন শুনে চমকে উঠেছিলাম।
কিন্তু এখন সেই শব্দ সবাই চেনে এবং এর সাম্প্রতিক ভয়ংকর সংস্করণ— একটি তীব্র বিকট শব্দ, যা অনেকেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জার্মান স্তুকা যুদ্ধবিমানের সঙ্গে তুলনা করছেন।
আসন্ন ড্রোনের গুঞ্জনে কঠিনপ্রাণ বাসিন্দারাও আবার বাঙ্কারে, মেট্রো স্টেশনে কিংবা আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিংয়ে ছুটছেন— যুদ্ধের প্রথম দিকের স্মৃতি ফিরিয়ে দিচ্ছে।
‘বাড়িটা কাগজের মতো কেঁপে উঠলো,’ গত রাতের ভারী হামলার পর কিয়েভের বাসিন্দা কাটিয়া এ কথা বলেন।
তিনি বলেন, ‘পুরো রাত আমরা বাথরুমে বসে কাটিয়েছি। আমি জীবনে প্রথমবার পার্কিং গ্যারেজে আশ্রয় নিয়েছি,’ জানালেন আরেক বাসিন্দা, স্ভিতলানা। তিনি বলেন, বাড়ি কাঁপছিল, নদীর ওপার থেকে আগুন দেখা যাচ্ছিল।
সব হামলায় প্রাণহানি হয় না, কিন্তু প্রতিটি আক্রমণ আতঙ্ক ছড়াচ্ছে, মনোবল ভেঙে দিচ্ছে।
গত সপ্তাহে কিয়েভের একটি আবাসিক ভবনে হামলার পর, আশ্রয়কেন্দ্রে ১১ বছর বয়সী নাতির কথা বলছিলেন মারিয়া নামের এক দাদি— নাতি তাঁকে বলেছে, সে প্রথমবার মৃত্যুর অর্থ বুঝেছে।
ভয়ের কারণও আছে। জাতিসংঘের ইউক্রেন মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ মিশন জানিয়েছে, গত জুন ছিল তিন বছরের মধ্যে সবচেয়ে প্রাণঘাতী মাস। এ মাসে নিহত হয়েছেন ২৩২ জন, আহত হয়েছেন ১ হাজার ৩০০ জনেরও বেশি।
অনেকে যুদ্ধক্ষেত্রের কাছাকাছি এলাকায় মারা গেলেও অনেকে প্রাণ হারিয়েছেন যুদ্ধ থেকে অনেক দূরের শহরগুলোতেও।
‘ড্রোন ও দূর-পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র হামলা বেড়ে যাওয়ায় যুদ্ধক্ষেত্র থেকে অনেক দূরের নাগরিকদের ওপরও নেমে এসেছে মৃত্যু ও ধ্বংস,’ বলেন জাতিসংঘের ইউক্রেন মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ মিশন প্রধান ড্যানিয়েল বেল।
আরও উন্নত, আরও বিধ্বংসী শাহেদ ড্রোন
শাহেদ ড্রোনের ডিজাইন বদলানো হয়েছে— এখন এটি আরও উঁচু দিয়ে উড়তে পারে এবং অনেক উঁচু থেকে নিচে নেমে টার্গেটে আঘাত হানতে পারে।
ড্রোনটির পাল্লা বেড়ে হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৫০০ কিমি এবং এটি আরও বেশি বিস্ফোরক বহনে সক্ষম (৫০ কেজি থেকে বেড়ে ৯০ কেজি)।
স্থানীয় বিশ্লেষকদের তৈরি মানচিত্রে দেখা গেছে, এই ড্রোনগুলো ঘুরপথে ইউক্রেন পেরিয়ে লক্ষ্যবস্তুতে গিয়ে পড়ছে।
অনেক ড্রোন, প্রায় অর্ধেকই, মূলত প্রতিরক্ষা বিভ্রান্ত করতে পাঠানো হচ্ছে— আসল লক্ষ্য নয়।
অন্যদিকে, সোজা পথে আসা বলিস্টিক বা ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র তুলনামূলক কম, কিন্তু এগুলোই বেশি ধ্বংস ডেকে আনে।
নতুন নতুন রেকর্ড ভাঙছে হামলা
ওয়াশিংটনভিত্তিক ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ার বলছে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের জানুয়ারির শপথের পর দুই মাসে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা বেড়েছে।
মার্চে কিছুটা কমলেও মে মাসে হঠাৎ করে বেড়ে যায়। তারপর থেকেই নতুন নতুন রেকর্ড ভাঙছে।
জুনে রেকর্ড ৫ হাজার ৪২৯টি ড্রোন ব্যবহার করে হামলা চালানো হয়েছে। জুলাই মাসের প্রথম ৯ দিনেই এই সংখ্যা ছাড়িয়েছে ২ হাজার।
রাশিয়া ড্রোন উৎপাদন আরও বাড়িয়েছে। কিছু প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মস্কো শিগগিরই এক রাতে এক হাজারের বেশি ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ছোড়ার সক্ষমতা অর্জন করতে পারে।
ইউক্রেনের ওপর চাপ বেড়েই চলেছে
কিয়েভের বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন—এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় দ্রুত সমাধান না পেলে ২০২৫ সালে ইউক্রেন আরও কঠিন সংকটে পড়বে।
‘অনেক ড্রোন সামরিক স্থাপনায় হামলা চালানোর চেষ্টা করছে—তা আমরা বুঝি। কিন্তু বাকি ড্রোনগুলো অ্যাপার্টমেন্ট, অফিস বিল্ডিং ভেঙে সাধারণ নাগরিকদের ক্ষতিগ্রস্ত করছে,’ বলছেন সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা ইভান স্তুপাক।
এই ড্রোনগুলো খুব জটিল প্রযুক্তির না হলেও রাশিয়া ও ইউক্রেনের সম্পদের ব্যবধানটা স্পষ্ট করে দেয়
এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় স্টালিনের বিখ্যাত উক্তি মনে করিয়ে দেয়, ‘পরিমাণ নিজেই এক ধরনের গুণ।’
‘এটা সম্পদের যুদ্ধ,’ বলছেন ইউক্রেনিয়ান সিকিউরিটি অ্যান্ড কো-অপারেশন সেন্টারের সেরহি কুজান।
তিনি বলেন, ‘বিশেষ ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির খরচ বেশি— জটিল যন্ত্রাংশ, সরবরাহ সমস্যা— তাই তারা এই নির্দিষ্ট ড্রোনে মনোযোগ দিয়েছে এবং এর নানা সংস্করণ তৈরি করেছে।”
এক হামলায় যত বেশি ড্রোন, ইউক্রেনের আকাশ প্রতিরক্ষা ইউনিটের কাজ তত কঠিন হয়। একসময় বাধ্য হয়ে বিমান ও মহামূল্যবান আকাশ-আকাশ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করতে হয়।
‘যদি ড্রোনগুলো ঝাঁকে ঝাঁকে আসে, তারা প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করে দেয়,’ বলেন কুজান।
সূত্র: বিবিসি