কুষ্টিয়ায় ১৮ কোটি টাকার সেতু উন্নয়ন নাকি জনদুর্ভোগ

Spread the love

আক্তারুল ইসলাম, কুষ্টিয়া

কুষ্টিয়ার মিরপুর বাজার ঘেঁষা জিকে ক্যানেলের উপর নির্মিতব্য নতুন সেতুটি নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ বিরাজ করছে। প্রায় ১৮ কোটি টাকার প্রকল্প হলেও ধীরগতির কাজ, নকশাগত জটিলতা এবং বিকল্প চলাচলের ব্যবস্থা না থাকায় ভোগান্তি যেন দিন দিন বাড়ছেই।

মিরপুর বাজার কুষ্টিয়া জেলার অন্যতম ব্যস্ততম এলাকা। জেলার দীর্ঘতম পশুহাট, উপজেলা পরিষদ, সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়সহ নানা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং মিরপুর-দৌলতপুর সড়কের সঙ্গে সংযোগের একমাত্র পথই হচ্ছে এই সেতু। প্রতিদিন কয়েক হাজার মানুষ ব্যবসায়িক কাজ, চিকিৎসা, শিক্ষা কিংবা অফিস-আদালতের প্রয়োজনে এ পথেই যাতায়াত করেন। ঝুঁকিপূর্ণ পুরনো কংক্রিট কাঠামোর পরিবর্তে নতুন করে সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় সড়ক ও জনপথ বিভাগ।

২০২৩ সালের ৮ নভেম্বর প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। নির্ধারিত মেয়াদ ছিল ২০২৫ সালের ৭ মে পর্যন্ত। ব্যয় ধরা হয় ১৮ কোটি ৬৭ লাখ টাকার বেশি। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ পায় কংক্রিট এন্ড স্টিল টেকনোলজিস লিঃ এবং রানা বিল্ডার্স প্রাঃ লিঃ। তবে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় মেয়াদ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ২০২৬ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত।

সরেজমিন দেখা যায়, এতদিনে কাজের অর্ধেকও শেষ হয়নি। প্রতিদিন দুই-তিনজন শ্রমিক দিয়ে গড়িমসি করে কাজ চালানোর অভিযোগ তুলেছেন স্থানীয়রা। সকালে কাজ হলে বিকালে বন্ধ থাকে, আবার বিকালে শুরু হলে সকালে থাকে না। বছরের পর বছর ধরে এভাবে চলায় এলাকার মানুষকে বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁশের সাঁকো ব্যবহার করতে হচ্ছে।

সেতুর পাশের দোকানদার গোলাম হোসেন বলেন,  এক বছর ধরে দেখি দু’একজন মিলে কখনো কাজ করছে, কখনো করছে না। এভাবে চললে আরও দেড় বছরেও ব্রিজ হবে না। তার উপর ব্রিজ থেকে নামার রাস্তার মুখেই নতুন পাঁচতলা ভবন তোলা হচ্ছে। ইঞ্জিনিয়াররা বলে যাচ্ছে কোনো সমস্যা হবে না, কিন্তু আমাদের সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।

ভ্যানচালক আব্দুল আজিজ জানান, ব্রিজটা এত উঁচু যে ছোট গাড়ি উঠতে কষ্ট হবে। রাস্তা যদি বাঁকা হয় তবে রিকশা-ভ্যান একেবারেই চলবে না। ব্রিজের মুখের সামনেই যদি ঘরবাড়ি থাকে তবে নামা-ওঠা আরও কষ্টকর হবে।

নির্মাণাধীন সেতু

স্থানীয় বাসিন্দা হুমায়ূন কবীর হিমু বলেন, দেড় বছর ধরে মানুষের দুর্ভোগ সীমাহীন পর্যায়ে পৌঁছেছে। ১০ টাকার ভাড়া এখন দিতে হচ্ছে ৬০ টাকা। কোনো রিকশা-অটো পার হয় না। মানুষকে ঝুঁকি নিয়ে বাঁশের সাঁকো পার হতে হয়।

তবে সড়ক ও জনপথ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, কাজ নির্ধারিত পরিকল্পনা অনুযায়ী চলছে। সাইট ম্যানেজার আলিফ হোসেন জানান, বৈদ্যুতিক লাইন স্থানান্তর, পুরনো ব্রিজের পাইল উঠানো, রেলের জমি এবং বাজার এলাকায় নতুন স্থাপনা গড়ে ওঠার কারণে কাজ বিলম্বিত হচ্ছে। এছাড়া ব্রিজ থেকে এপ্রোচ রাস্তা সোজা না হয়ে বাঁকা হবে। ফলে নান্দনিকতা কিছুটা কমলেও চলাচলে সমস্যা হবে না বলে দাবি তার।

অন্যদিকে কুষ্টিয়া সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মুহাম্মদ মনজুরুল করীম বলেন, ব্রিজের প্রায় ৪৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। পিসি গার্ডার বসানোর কাজ চলছে। টেকনিক্যাল স্ট্যান্ডার্ড মেনেই উচ্চতা নির্ধারণ করা হয়েছে। আশা করছি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই কাজ শেষ হবে। ব্রিজটি জেলার মধ্যে অন্যতম দৃষ্টিনন্দন হবে এবং মানুষ এর সুফল পাবে।

ব্রিজের মুখেই নতুন করে পাঁচতলা ভবন নির্মাণ শুরু করেছিলেন বাজারের ব্যবসায়ী নেতা বাবলু চৌধুরী। তবে পৌরসভার অনুমোদন না থাকায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সেটি বন্ধ করে দেন। বাবলু চৌধুরীর দাবি, ব্রিজের উচ্চতা মানুষের জন্য দুর্ভোগ ডেকে আনবে। এখানে উন্নয়নের বদলে সমস্যা বাড়ছে।

মিরপুর পৌর প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমুল ইসলাম বলেন, মার্কেট নির্মাণের নকশায় ১৩টি জায়গায় সংশোধনী চাওয়া হয়েছিল। অনুমোদন না হওয়া পর্যন্ত কাজ বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে।

১৮ কোটি টাকার সেতুটি নির্মিত হলে স্থানীয় মানুষের দীর্ঘদিনের দুর্ভোগ লাঘব হবে বলে আশ্বাস দিচ্ছে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ধীরগতির কাজ, অস্বাভাবিক উচ্চতা এবং বাজার এলাকায় নতুন দালান নির্মাণের কারণে এলাকাবাসীর মধ্যে শঙ্কা বাড়ছে। তাদের আশঙ্কা—সেতুটি পরিণত হবে “উন্নয়নের প্রতীক” নয়, বরং গলার কাঁটাতে।

 


Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *