পুরনো বৃত্তেই বাংলাদেশ ব্যাংক: স্থবির ব্যবসা-বাণিজ্য-বিনিয়োগ

Spread the love

নিউজ ডেস্ক, জনতারকথা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের যথাযথ পদেক্ষেপের অভাবে কাটছে না ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যকে সচলের চেষ্টা করলেও বাস্তবায়ন দুর্বলতায় এর সুফল মিলছে না। অনেকে বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখনো পুরনো বৃত্তেই ঘুরপাক খাচ্ছে। এর ফলে অন্তর্বর্তী সরকারের গত ১১ মাসেও এই পরিস্থিতির কোন উন্নতি লক্ষ্য করা যায়নি।

পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, বেসরকারি ব্যাংকের কিছু পর্ষদ বদল, দুর্বল ব্যাংকগুলোকে টাকা ছাপিয়ে সহায়তা করা ছাড়া উল্লেখযোগ্য বড় কোনো পরিবর্তন হয়নি। বরং আন্দোলন পরবর্তী মন্দার কবলে পড়া অর্থনীতির জন্য যে রকমের নীতি সহায়তা ও সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কথা, সেগুলোরও বাস্তব প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না।

ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য বিনিয়োগ বাড়ছে না। মানুষেরও কাজের সুযোগ হচ্ছে না। উল্টো আগের ধারাবাহিকতায় ভুল নীতির খেসারত দিচ্ছে ব্যবসায়ীসমাজ। কারো কারো শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। মোটা লোকসানে পড়ে ব্যাংকে খেলাপিও হয়ে পড়ছেন অনেকে। বলতে গেলে কঠিন সময় পার করছেন উদ্যোক্তারা।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে বর্তমানে ব্যবসা পরিচালনার জন্য অনুকূল পরিবেশ অনুপস্থিত। উচ্চ সুদের হার, ব্যাংকঋণ গ্রহণে জটিলতা এবং নানা ধরনের নিয়ন্ত্রক বাধার কারণে নতুন উদ্যোক্তা যেমন নিরুৎসাহ হচ্ছেন, তেমনি বিদ্যমান উদ্যোক্তারা কার্যক্রম বিস্তারে আগ্রহ হারাচ্ছেন। পরিস্থিতি এতটাই সংকটময় যে ব্যবসায়ী সমাজ ছয় মাস পর্যন্ত খেলাপি ঋণের আইন শিথিল করার দাবি তুলেছে। তাঁদের মতে, মহামারি-পরবর্তী আর্থিক চাপে অনেকেই অনিচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি হয়েছেন, এখন আইনি জটিলতায় তাঁদের আরো বিপাকে পড়তে হচ্ছে।

এদিকে বড় ঋণের সহায়তায় কমিটি গঠনের সাড়ে পাঁচ মাসেও তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। সময় চলে যাচ্ছে যাচাই-বাছাইয়ে। এ সময় প্রায় এক হাজার ২৫০টি আবেদন জমা পড়লেও কমিটি এখন পর্যন্ত যাচাই-বাছাই করেছে মাত্র ১০০টি। দীর্ঘসূত্রতার ফলে বড় বড় শিল্প গ্রুপগুলো অনিচ্ছাকৃত খেলাপি হয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাঙ্ক্ষিত সহায়তা না পেয়ে আরো রুগ্ণ হয়ে পড়ছে। কোনো কোনোটি বন্ধ হয়ে বিপুলসংখ্যক কর্মীর চাকরি হারানোর ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।

ব্যাংকিং খাতকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে ঋণ শ্রেণীকরণ নীতিমালা কঠোর করা হয়েছে। তবে এতে খেলাপি ঋণ কমার বদলে উল্টো বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য বলছে, এপ্রিল ২০২৫ থেকে কার্যকর হওয়া নতুন নিয়ম অনুযায়ী তিন মাস ঋণ পরিশোধ না করলে সেটি সরাসরি খেলাপি হিসেবে গণ্য হচ্ছে। ফলে আগের ছয় মাস অপেক্ষার বিধান বাতিল হওয়ার পর থেকেই ঋণের শ্রেণীকরণে বড়সড় পরিবর্তন দেখা দিয়েছে।

নতুন নিয়মে ব্যাংকগুলোকে খেলাপি ঋণ লুকানোর সুযোগ নেই বললেই চলে। এতে স্বচ্ছতা বাড়লেও হঠাৎ করে খেলাপির সংখ্যা ও পরিমাণ কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। মার্চ ২০২৫ শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে শ্রেণীকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় চার লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি, যা ২০২৪ সালের তুলনায় প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা বেশি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু নিয়মের কঠোরতা নয়, বাস্তবে অর্থনৈতিক মন্দা, বিনিয়োগ স্থবিরতা এবং রাজনৈতিক প্রভাবেও খেলাপির হার বাড়ছে। দীর্ঘ সময় ধরে দুর্বল প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের ঋণ সুবিধা দেওয়া হয়েছে, যেগুলোর বড় অংশই পরিশোধ করা হয়নি। এসব ঋণ এত দিন ‘লুকিয়ে রাখা’ হলেও নতুন নিয়মে তা প্রকাশ পাচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, কয়েকটি ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরে বড় বড় গ্রাহকের অনিয়মিত ঋণকে পুনঃ তফসিল করে খেলাপি দেখায়নি। কিন্তু এখন সেই সুযোগ না থাকায় প্রকৃত খেলাপির হিসাব বেরিয়ে এসেছে। এতে যেমন ব্যাংকের আর্থিক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে, তেমনি পুঁজিবাজার ও বিনিয়োগ পরিবেশেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

বিশ্লেষকদের মতে, নিয়মের কঠোরতা অপরিহার্য হলেও তা বাস্তব প্রেক্ষাপটে পর্যবেক্ষণ ও প্রয়োজনীয় নীতিগত সমন্বয় ছাড়া কার্যকর করা হলে আর্থিক খাতে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি হতে পারে। তাঁরা মনে করেন, খেলাপি রোধে আইনের প্রয়োগের পাশাপাশি দুর্নীতি ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করাও জরুরি।

সম্প্রতি আগারগাঁওয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কার্যালয়ে আয়োজিত এই বৈঠকে বিজিএমইএ প্রতিনিধিদল প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরীকে ঋণখেলাপি সমস্যা সমাধানে পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরোধ জানায়। তারা বলে, ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময়সীমা ৯ মাস থেকে কমিয়ে তিন মাস করা হয়েছে। অনেক সময় আর্থিক কারণে উদ্যোক্তা এই সময়ের মধ্যে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারেন না। ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময়সীমা ছয় মাসে উন্নীত করা হলে ৫০০-৬০০ পোশাক কারখানা ক্লাসিফায়েড ঋণ থেকে রক্ষা পাবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক এরই মধ্যে একটি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কম্পানি (এএমসি) গঠনের চিন্তা-ভাবনা করছে, যেখানে বড় খেলাপি ঋণগুলো স্থানান্তরের মাধ্যমে পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করা হবে। সব মিলিয়ে কঠোর আইন খেলাপি ঋণের গায়ে স্বচ্ছতার আলো ফেললেও বাস্তব সমাধানে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি কাঠামোগত সংস্কার। তা না হলে শুধু আইন কঠোর করেই খেলাপি সংকট মোকাবেলা করা সম্ভব নয় বলে মত অর্থনীতিবিদদের।

এদিকে দেশে উচ্চ নীতিসুদের কারণে বেসরকারি বিনিয়োগে ভয়াবহ স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক একাধিকবার নীতি সুদহার (পলিসি রেট) বাড়ানোর পর তার সরাসরি প্রভাব পড়েছে ঋণের ওপর। এখন ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে গেলে ১৪ থেকে ১৬ শতাংশ পর্যন্ত সুদ গুনতে হচ্ছে উদ্যোক্তাদের, যা অনেক ব্যবসার জন্যই অনভিপ্রেত ও অস্বাভাবিক।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক টানা রেপো রেট বাড়িয়ে চলছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বর্তমান নীতিসুদের হার ১০ শতাংশে পৌঁছেছে। এর প্রভাবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ঋণের সুদহারও বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে উৎপাদনশীল খাতে ঋণ নিয়ে নতুন ব্যবসা শুরু করা বা বিদ্যমান বিনিয়োগ সম্প্রসারণ অনেকটাই বন্ধ হয়ে গেছে। এমনকি বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের নিচে নেমে গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘আমরা ব্যবসায়ীদের জন্য একটি সুস্থ ও প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরিতে কাজ করছি। আগের সরকারের আমলে ব্যাংকিং খাত যেভাবে ধ্বংস করা হয়েছে, তা পুনরুদ্ধার করতে সময়ের প্রয়োজন। আগের সকরারের আমলে নির্দিষ্ট কয়েকটি শিল্পগোষ্ঠীর হাতে পুরো ব্যাংকিং খাত চলে গিয়েছিল। ফলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি একেবারেই ছিল না। আমরা চাই, ভবিষ্যতে আর যেন এমন না হয়। এ জন্যই ব্যাংক খাতকে একটি শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে বাংলাদেশ ব্যাংক নীতিগত সংস্কার ও নিয়ন্ত্রণ জোরদার করেছে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের আরেক নির্বাহী পরিচালক (মুদ্রানীতি বিভাগ) ড. মো. এজাজুল ইসলাম বলেন, ২০১৫ সালের পর থেকে একটি পরিবার ব্যাংক খাতকে নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা শুরু করেছিল। ওই সর্বনাশের পাশাপাশি ব্যাংকঋণের সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনা ছিল সবচেয়ে বড় ভুল। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়ানোর নামে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ হয়নি, বরং বিপুল অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে। অর্থাৎ শুধু সুদহার কমালেই বিনিয়োগ বাড়ে—এমন ধারণা ভুল।

ডলারের অস্বাভাবিক দরবৃদ্ধিতে ভয়াবহ বিপাকে পড়েছেন দেশের আমদানিনির্ভর ব্যবসায়ীরা। বিশেষ করে কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি ও খাদ্যপণ্য আমদানিকারকদের মধ্যে দেখা দিয়েছে চরম উদ্বেগ। কারণ একই পণ্য আমদানির জন্য অতিরিক্ত ৩০-৪০ শতাংশ টাকা বেশি গুনতে হচ্ছে, যা তাঁদের মুনাফা খেয়ে নিচ্ছে। অনেকে বাধ্য হয়ে এলসি বাতিল করছেন, আবার কেউ উৎপাদন বন্ধ বা সীমিত করে ফেলছেন।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অতীতের ভুল নীতির খেসারত এখন দিতে হচ্ছে পুরো অর্থনীতিকে। বর্তমান নীতিনির্ধারকরা উদ্ভাবনী ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে সহজ ও দ্রুততম সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি ফেরাতে পারবে এমন নীতি সহায়তা দেবেন বলে আশা করা হলেও কার্যত তেমন পদক্ষেপ নেই। ব্যবসায়ীরা আশা করছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেসব নীতিমালা প্রণয়ন করছে, তা ব্যবসা-বিনিয়োগের জন্য কতটা সহায়ক তার একটা পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা প্রয়োজন এবং দ্রুততম সময়ে সিদ্ধান্ত কার্যকর করা দরকার।


Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *