
প্রাথমিক থেকেই শুরু হোক শিশুদের বই পড়ার অভ্যাস
– মহাম্মদ সামসুল হক
একটা সময় ছিল, যখন সন্ধ্যার পর গ্রামগঞ্জে বাড়ির আঙিনায় কিংবা উঠোনে বসে ঠাকুরমার ঝুলির গল্প শোনার হুলস্থুল আনন্দ হতো। চারদিকে মৃদু বাতাস বইত, কেরোসিনের কুপির আলোয় টিমটিম করত মুখগুলো। সেই আলো-আঁধারিতে দাদির মুখে ‘এক ছিল রাজা, এক ছিল রানী’ শুনতে শুনতে মুগ্ধ হয়ে যেত শিশুরা। তখন শিশুরা জানতো না, তারা গল্প শোনার সঙ্গে সঙ্গে এক নতুন জগতে প্রবেশ করছে, যেখানে কল্পনা, অনুভব আর ভাষা মিলেমিশে তৈরি করছে তাদের ভেতরের মানুষটিকে।
এখন সময় বদলেছে। এখন চারপাশে ডিজিটাল পর্দার ঝলকানি, হাতে হাতে মোবাইল, চোখে চোখে ট্যাব। ছোট্ট শিশুটিও যেন আধুনিক যন্ত্রের বন্দি। খেলাধুলা, আড্ডা কিংবা গল্প- সব যেন পর্দার আড়ালে। অথচ শিশুদের মনকে গঠনের সবচেয়ে শক্তিশালী উপায়গুলোর একটি হলো বই পড়া। বই শুধু শব্দের পৃষ্ঠা নয়, বই এক বিস্ময়-ভরা দরজা, যার ওপারে অপেক্ষা করে থাকে সাহসী নায়ক, মজার প্রাণী, দূরের দেশ, অদ্ভুত চরিত্র আর মায়াময় গল্প।
আমি যখন আমার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্লাসে প্রবেশ করি, শিশুদের চোখে-মুখে এক ধরনের কৌতূহল দেখি। গল্প বলতে শুরু করলেই চোখদুটো চকচক করে ওঠে। কাগজের পাতায় আঁকা বড় বড় ছবির সঙ্গে যখন গল্পের কণ্ঠ মিলে যায়, তখন তাদের চোখ যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এই আগ্রহটাই আমাদের ধরতে হবে। শিশুর বয়স যখন কেবলই শব্দ চেনা শুরু করে, ঠিক তখন থেকেই যদি বইয়ের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে, তবে সে নিজে থেকেই একদিন বড় হয়ে ওঠার পথ খুঁজে নেবে।
বই পড়ার শুরুটা হতে পারে খুব ছোট পরিসরে। প্রথমে অভিভাবক কিংবা শিক্ষক গল্প পড়ে শোনান, শিশুর পাশে বসে গল্পের চরিত্রগুলো নিয়ে কথা বলেন, কল্পনার পাখা মেলে দেন। ধীরে ধীরে শিশুটিও নিজের মতো করে গল্পে ঢুকে পড়ে। সে ভাবতে শুরু করে- ‘এই গল্পের শেষে কী হবে?’ ‘এই নায়ক যদি আমি হতাম?’ এখানেই বই পড়ার জাদু। বই শিশুর কল্পনাকে জাগিয়ে তোলে, শব্দভা-ারকে সমৃদ্ধ করে, আবেগকে শানিত করে।
শুধু পাঠ্যবই নয়, পাঠ্যবইয়ের বাইরের বই পড়াও জরুরি। কারণ পাঠ্যবই শেখায় পরীক্ষার জন্য, কিন্তু গল্পের বই শেখায় জীবনের জন্য। শিশুরা যখন কবিতা পড়ে, গল্প পড়ে, তখন তারা ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতায় নিজেদের মেলাতে শেখে। তারা আবেগের গভীরতা বোঝে, সাহসী হতে শেখে, অন্যের দুঃখ বুঝতে শেখে। শিশুরা বই পড়ে জানে যে, ভালো হওয়াটাই আসল, রূপ নয়। তারা বুঝে যায় যে প্রতিটি মানুষই ভিন্ন, প্রতিটি স্বপ্নের একটা মূল্য আছে।
আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলি, যখন শিশুর হাতে একটি বই তুলে দেওয়া হয়, সে শুধু একটা বই পায় না, সে পায় একজন নতুন বন্ধু। সে বইয়ের পাতায় চড়ে ঘুরে আসে সাগরের তলদেশ, হিমালয়ের চূড়া, মিশরের পিরামিড কিংবা আফ্রিকার মরুভূমি। ছোট্ট গ্রামে বসেই সে জানতে পারে পৃথিবীর বিস্ময়গুলো। তাই বই পড়া শিশুদের চোখে শুধু দৃষ্টি নয়, দিগন্ত খুলে দেয়।
প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। শিশুরা এখন নানা চাপে থাকে- স্কুল, কোচিং, হোমওয়ার্ক, পরীক্ষার ভয়। এর মধ্যে বই হতে পারে তাদের মুক্তির রাস্তা। প্রতিদিন মাত্র দশ মিনিট হলেও বইয়ের সঙ্গে সময় কাটানো তাদের মনকে হালকা করে, আনন্দে ভরে দেয়। আর এই আনন্দের চর্চা থেকেই একদিন তৈরি হবে বইপ্রেমিক মানুষ, যারা গড়বে আলোকিত সমাজ।
এ জন্য দরকার বাবা-মা, শিক্ষক আর সমাজের সম্মিলিত চেষ্টার। ঘরে ঘরে তৈরি হোক বইয়ের ছোট্ট পাঠাগার। শিশুর হাতে তুলে দিন বই। খেলনার পরিবর্তে দিন গল্পের বই, ছড়ার বই। জন্মদিনে উপহার দিন নতুন বই। শিশুকে নিয়ে যান বইমেলায়, গ্রন্থাগারে। আর সবচেয়ে বড় কথা, বড়রা নিজেরাই পড়ুন। কারণ শিশু শেখে দেখে, অনুকরণ করে।
প্রযুক্তির এ যুগে বই হয়তো কিছুটা কোণঠাসা, কিন্তু আজও বইয়ের পাতা ওলটালেই মেলে সাহস, ভালোবাসা, অনুভব আর জ্ঞান। প্রাথমিক থেকেই যদি শিশুর সঙ্গে বইয়ের বন্ধুত্ব শুরু হয়, তবে তারা হবে আরও সৃজনশীল, মানবিক ও কল্পনাপ্রবণ মানুষ। শিশুর হাতে বই তুলে দিয়ে শুরু হোক এক মুগ্ধ পাঠযাত্রা- যার শেষ গন্তব্য আলোকিত আগামী।
মহাম্মদ সামসুল হক
সহকারী শিক্ষক, কুশাবাড়ীয়া চরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মিরপুর, কুষ্টিয়া।