কুষ্টিয়ায় সীমানা জটিলতায় পদ্মা পাড়ের মানুষের সীমাহীন ভোগান্তি

Spread the love

কুষ্টিয়া অফিস।

কাগজে কুষ্টিয়ার বাসিন্দা, জীবনে পাবনার ওপর নির্ভরশীল—প্রশাসনিক জটিলতায় উন্নয়ন বঞ্চিত অবহেলায় ডুবে আছে পদ্মা পাড়ের হাজারো মানুষ

প্রমত্তা পদ্মার বুক চিরে প্রতিদিন যাতায়াত করতে হয় কুষ্টিয়া ও পাবনার সীমান্তবর্তী ১৬ গ্রামের প্রায় ৪০ হাজার মানুষকে। প্রশাসনিক কাগজে তারা কুষ্টিয়া বা পাবনার বাসিন্দা হলেও জীবনের প্রায় সব চাহিদাই মেটাতে হয় অন্য জেলায় গিয়ে। নদী-বালুর অন্তহীন পথ পাড়ি দেওয়া এই মানুষের জীবন যেন এক দীর্ঘ দুঃখগাথা।

কুষ্টিয়ার চরসাদিপুর ইউনিয়নের ৯টি গ্রাম রয়ে গেছে পদ্মার এপারে, পাবনার গা ঘেঁষে। আবার সীমানার অদ্ভুত জটিলতায় পাবনা সদর উপজেলার ভাড়ারা ও দোগাছি ইউনিয়নের ৭টি গ্রাম চলে গেছে পদ্মার ওপারে, কুষ্টিয়ার কুমারখালীর পাশে। ফলে প্রশাসনিকভাবে এক জেলায়, অথচ জীবন-জীবিকা সম্পূর্ণ অন্য জেলায়— এমন অস্বস্তিকর বাস্তবতায় যুগ যুগ ধরে দিন কাটছে হাজারো মানুষের।

কুষ্টিয়া ও শিলাইদহ ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, অর্ধঘণ্টা পরপরই নৌকায় করে নদী পার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। শিক্ষার্থী, চাকরিজীবী থেকে শুরু করে কৃষক—সবারই একই গন্তব্য, নিজ জেলার অফিসকাছারি বা বাজার। কেউ চিকিৎসার জন্য আসছেন, কেউ জমিজমার কাগজপত্রে সই করতে। শুষ্ক মৌসুমে পদ্মার ধুধু বালুচরে পাঁচ কিলোমিটার হাঁটা তাদের নিত্যদিনের যন্ত্রণা।

কুষ্টিয়া কুমারখালীর কলেজছাত্র আবু সালেহীন জানান, পাসপোর্টের কাজ করতে পাবনা শহরে যেতে হয়। বর্ষায় নৌকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নদী পাড় হতে হয়। বছরের পর বছর ধরে আমরা একই দুর্ভোগে আছি। পাবনার ভাঁড়ারা ইউনিয়নের সচিব সেলিম উদ্দিন বলেন, নদীর ওপারে থাকা ৭ গ্রামের মানুষ ইউপি কার্যালয় বা কোর্ট-কাছারির কাজে এপারে আসেন। এতে সময়, অর্থ ও ঝুঁকি সবই বেড়ে যায়।

কুষ্টিয়ার চরসাদিপুর ইউনিয়নের অবস্থাই সবচেয়ে করুণ। ২৫ বর্গমাইল আয়তনের এ ইউনিয়নে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ বসবাস করলেও নেই সঠিক সড়ক, নেই পর্যাপ্ত শিক্ষা কিংবা চিকিৎসা ব্যবস্থা। সরজমিনে দেখা গেছে, সড়কে বড় বড় গর্ত; ইট-খোয়া বিলীন হয়ে গেছে। শুষ্ক মৌসুমে ধুলায় হাঁটুসম ধোঁয়া উড়ছে, বর্ষায় রাস্তাঘাট কাদার সাগরে পরিণত হয়।

প্রশাসনিক নজরদারি না থাকায় এলাকায় বেড়ে চলেছে মাদক, বাল্যবিবাহ, চুরি-ডাকাতিসহ নানা অপরাধ। স্থানীয়দের অভিযোগ, সরকারি কোনো সেবা পৌঁছায় না এই দুর্গম চরে। সার, বীজ কিংবা ত্রাণ—সবখানেই তারা বঞ্চিত।

অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা নিয়মিত পড়াশোনা করে পাবনার স্কুল-কলেজে। তবে এসএসসি বা এইচএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র হয় কুষ্টিয়ায়। ফলে নদী পাড়ি দিতে না পারায় অনেকেই সঠিক সময়ে কেন্দ্রে পৌঁছাতে পারেন না। এতে শিক্ষা কার্যক্রমে মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। চরসাদিপুরের তরুণদের অনেকেই এখন ভোটার হয়েছেন পাবনার। পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্র রিমন হোসেন জানান, আমরা চরসাদিপুরের মানুষ, কিন্তু ভোটার হয়েছি পাবনার। এখানকার নতুন প্রজন্মও ভোটার হচ্ছে পাবনায়।

সমাধানের দাবিতে সরব জনপদ, স্থানীয়রা মনে করেন, পদ্মা নদী বিচ্ছিন্ন এ বৃহৎ জনগোষ্ঠীর বাস্তবতার ভিত্তিতে নিকটবর্তী জেলার সঙ্গে প্রশাসনিকভাবে যুক্ত করাই হতে পারে একমাত্র সমাধান। অন্যথায় কাগজে-কলমে এক জেলার, জীবনে অন্য জেলার এই অবহেলার চক্র থেকে মুক্তি মিলবে না।

তাদের দাবি, জনগণের দীর্ঘদিনের ভোগান্তি লাঘবে সরকারকে দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে। শুধু সীমানা নির্ধারণই নয়, আধুনিক সড়ক, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষি সুবিধা নিশ্চিত করলেই এই মানুষগুলো উন্নয়নের মূলধারায় ফিরতে পারবে।

 

 


Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *