
আক্তরুল ইসলাম, কুষ্টিয়া ।
জীবন সংগ্রামের পথ বড়ই কণ্টকাকীর্ণ। কখনো কখনো এক ফোঁটা আশা যেন এক বিশাল আলোর দিগন্ত হয়ে আসে হতাশার অন্ধকারে ডুবে থাকা মানুষের জীবনে। তেমনই এক অনন্য মানবিকতার দৃষ্টান্ত দেখা গেল কুষ্টিয়ায়। চুরি হয়ে যাওয়া একমাত্র জীবিকার ভ্যান হারিয়ে হতাশায় নিমজ্জিত রমজান আলী আজ আবার ঘুরে দাঁড়ালেন নতুন ভ্যান হাতে পেয়ে। আর এই সহযোগিতার পেছনে ছিলেন এক জার্মান প্রবাসী বাংলাদেশি, যিনি দূর দেশ থেকে মানবতার টানে এগিয়ে এসেছেন।
রমজান আলী (৫২) পেশায় ভ্যানচালক। বাড়িঘর নেই, জমিজমা নেই সরকারি খাস জমিতে কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার হালসা রেললাইনের পাশে একটি ছোট্ট ঘর তুলে স্ত্রী সন্তান নিয়ে কোনোমতে দিনাতিপাত করেন তিনি। তাঁর জীবিকার একমাত্র ভরসা ছিল একটি পাখিভ্যান। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ভ্যান চালিয়ে যে সামান্য আয় হতো, তা দিয়েই সংসার চলত।
কিন্তু গত সোমবার ১ সেপ্টেম্বর রাতে দুর্বৃত্তরা তাঁর ভ্যানটি চুরি করে নিয়ে যায়। হঠাৎ করে জীবিকার একমাত্র অবলম্বন হারিয়ে রমজান আলী ও তাঁর পরিবার দিশেহারা হয়ে পড়েন। পরদিন ভ্যান চুরির খবরটি দৈনিক জনতারকথা নিউজ পোর্টালে প্রকাশিত হয়। সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হলে অনেকের মনেই নাড়া দেয় ঘটনাটি।
সংবাদটি নজরে আসে কুষ্টিয়ার পাটিকাবাড়ীর সন্তান জার্মান প্রবাসী ফারুক আহমেদের। বিদেশের মাটিতে থেকেও তিনি নিয়মিত দেশের খবরাখবর রাখেন। অসহায় রমজান আলীর দুর্দশার কথা জেনে মানবিক দায়িত্ববোধ থেকে তিনি দ্রুত উদ্যোগ নেন। ফারুক আহমেদ স্থানীয় কিছু শুভাকাঙ্ক্ষীর সঙ্গে যোগাযোগ করে রমজান আলীর জন্য নতুন একটি ভ্যান কেনার ব্যবস্থা করেন।
মঙ্গলবার ২ সেপ্টেম্বর কুষ্টিয়ার বটতৈল মোড়ে এক অনাড়ম্বর আয়োজনে রমজান আলীর হাতে নতুন ভ্যানটি তুলে দেওয়া হয়। উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিক ও এলাকাবাসী।
ভ্যান হাতে পেয়ে আনন্দে কান্না জড়িয়ে আসে রমজান আলীর চোখে। তিনি আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলেন,
আমার ভ্যান চুরি যাওয়ার পর মনে হয়েছিল, আর হয়তো ভ্যান চালাতে পারব না। সংসার কিভাবে চলবে ভেবে পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। আজ আবার ভ্যান হাতে পেয়ে মনে হচ্ছে আমি নতুন জীবন ফিরে পেলাম। আমি দোয়া করি, যিনি আমাকে সাহায্য করেছেন, আল্লাহ তাকে সুখে-শান্তিতে রাখুন।
জার্মান প্রবাসী ফারুক আহমেদ অনলাইনে জানালেন, সংবাদটি পড়ার পর ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলাম। একজন মানুষ যখন দিন আনে দিন খায়, তখন জীবিকার একমাত্র উপায় হারিয়ে ফেলা মানে জীবনের সবকিছু হারানো। আমি বিশ্বাস করি, আমরা যদি সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াই, তাহলে সমাজ অনেক সুন্দর হবে।
ঘটনাটি শুধু একটি ভ্যান হস্তান্তরের ঘটনা নয় এটি মানবিকতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ইতিবাচক ব্যবহারের মাধ্যমে কিভাবে একটি অসহায় পরিবার নতুনভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারে, তারই প্রতিফলন এটি।
স্থানীয়রা বলছেন, সমাজে এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন হলে আরও অনেক প্রবাসী ও সক্ষম মানুষ মানবিক সহায়তায় এগিয়ে আসবেন। এলাকার বাসিন্দা নূরুল ইসলাম বলেন, রমজান ভাইয়ের পরিবার খুব কষ্টে ছিল। ভ্যান হারিয়ে তারা একেবারে পথে বসার উপক্রম হয়েছিল। এখন নতুন ভ্যান হাতে পেয়ে তাদের মুখে হাসি ফুটেছে। আমরা কৃতজ্ঞ সেই প্রবাসী ভাইয়ের প্রতি।
বাংলাদেশে এখনও অসংখ্য পরিবার আছে যাদের জীবিকা নির্ভর করে একমাত্র একটি গাড়ি, রিকশা বা ভ্যানের ওপর। এ ধরনের ক্ষুদ্র সম্পদ হারালে পরিবারগুলো দারিদ্র্যের গভীর খাদে পড়ে যায়। সরকারের পাশাপাশি সমাজের বিত্তবান ব্যক্তি ও প্রবাসীদের মানবিক উদ্যোগই পারে এই দুঃস্থ পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়াতে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সংবাদমাধ্যমের ইতিবাচক ভূমিকা এবং প্রবাসীদের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয় দেশের উন্নয়ন ও সামাজিক বন্ধনকে আরও সুদৃঢ় করতে পারে।
একটি ভ্যান হয়তো সাধারণ মানুষের কাছে তেমন বড় কিছু নয়, কিন্তু রমজান আলীর মতো অসহায় পরিবারের জন্য এটি জীবন-জীবিকার মূল চালিকাশক্তি। নতুন ভ্যান হাতে পেয়ে তাঁর চোখের জলই যেন প্রমাণ করল, মানবিকতা এখনও বেঁচে আছে। সমাজের প্রত্যেকটি স্তরে যদি এভাবেই মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়ায়, তাহলে দারিদ্র্য বা হতাশা কোনোদিনই দীর্ঘস্থায়ী হবে না।
রমজান আলীর নতুন ভ্যানটি শুধু একটি যানবাহন নয়, এটি তাঁর পরিবারের বেঁচে থাকার আশার প্রতীক, মানবিকতার জয়গান এবং সমাজের জন্য অনুপ্রেরণার এক অনন্য দৃষ্টান্ত।