
৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর থেকে ঢাকার সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক নেই দিল্লির। যদিও ঢাকা একাধিকবার বন্ধুত্ব ও সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বার্তা দিয়ে এসেছে। তবু অস্বস্তি কাটেনি। এমন পটভূমিতে আজ শুক্রবার থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে বৈঠকে বসতে যাচ্ছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। বৈঠকের প্রস্তুতি হিসেবে সহাবস্থান ও বন্ধুত্বের বার্তা নিয়ে গেছে ঢাকা। একই সঙ্গে বাংলাদেশ নিয়ে দিল্লির প্রশ্নের যৌক্তিক জবাবের প্রস্তুতিও রাখা হয়েছে। কূটনৈতিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টিসেক্টরাল, টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশনের (বিমসটেক) শীর্ষ পর্যায়ের সম্মেলনে যোগ দিতে গতকাল বৃহস্পতিবার থাইল্যান্ড পৌঁছান প্রধান উপদেষ্টা। আজ বিমসটেক সম্মেলনের পরে সাইডলাইনে বৈঠক করবেন বাংলাদেশ ও ভারতের সরকারপ্রধান। যদিও ভারতের তরফ থেকে এ বৈঠকের বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এখনও কিছু জানানো হয়নি। আজই প্রধান উপদেষ্টার ঢাকা ফেরার কথা রয়েছে।
২৮ মার্চ ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, ৩ থেকে ৬ এপ্রিল থাইল্যান্ড ও শ্রীলঙ্কা সফর করবেন নরেন্দ্র মোদি। এ সময় ব্যাংককে বিমসটেক সম্মেলনে যোগ দেওয়ার পাশাপাশি মোদি থাই প্রধানমন্ত্রী এবং কলম্বোতে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠক করবেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ৫ আগস্ট পরবর্তী ঢাকার পক্ষ থেকে দিল্লিকে একাধিকবার বন্ধুত্বের বার্তা দেওয়া হয়। তার পরও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে নালিশ, আগরতলায় বাংলাদেশ মিশনে হামলা, সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে মিথ্যা তথ্য ছড়ানো, দেশটির গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে দেওয়া, অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের মতো ঘটনা ঘটিয়েছে দিল্লি। এ ছাড়া দেশটির কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা বাংলাদেশকে খাটো করতে সরব। এমনকি গতকাল বিমসটেকের মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর প্রধান উপদেষ্টার ‘সাত অঙ্গরাজ্য’ নিয়ে চীনে করা মন্তব্যের পাল্টা বক্তব্য দিয়েছেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ৫ আগস্টের পর ঢাকা-দিল্লির যে সম্পর্ক, তাতে বৈঠকে যে কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। বৈঠকটি যে আন্তরিক হবে, এর সুস্পষ্ট বার্তা এই মুহূর্তে নেই। ফলে ভারত তাদের নেরেটিভ অনুযায়ী প্রশ্ন করবে, উস্কানি দেবে, উত্তেজনা ছড়ানোর চেষ্টা করতে পারে। ফলে সে অনুযায়ী প্রস্তুতি রাখছে ঢাকা। যেমন তারা যদি ‘সাত অঙ্গরাজ্য’ নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার সাম্প্রতিক মন্তব্য নিয়ে প্রশ্ন তোলে, তাহলে বাংলাদেশ জবাব দেবে– এ কথা ভারতে দাঁড়িয়ে ২০২৩ সালে জাপানের প্রধানমন্ত্রী বলে গেছেন। যদি সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে বলে, তাহলে প্রতিটি ঘটনার সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সরকার কী ব্যবস্থা নিয়েছে, তা তুলে ধরা হবে।
সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের (ইউএনজিএ) সাইডলাইনে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের ব্যাপারে ঢাকার তরফ থেকে অনুরোধ জানানো হয়। তবে ইউএনজিএতে প্রধান উপদেষ্টা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী যোগ দিলেও দেখা হয়নি। নরেন্দ্র মোদি ভারতে চলে আসার পর ড. ইউনূস নিউইয়র্কে পৌঁছেছিলেন। আর গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ও ভারতের সরকারপ্রধান পর্যায়ে বৈঠক হয়নি। তবে সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর ড. ইউনূসকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন মোদি। এ ছাড়া গত ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসেও প্রধান উপদেষ্টাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। ফলে এটাই হতে যাচ্ছে তাদের প্রথম বৈঠক।
খলিলুর-দোভালের আলোচনা
এদিকে গতকাল রাতে ব্যাংককে প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সমস্যা ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলি-সংক্রান্ত হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ ড. খলিলুর রহমানের সঙ্গে নৈশভোজের ফাঁকে আলোচনা করেছেন ভারতের নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল। তবে তারা কী নিয়ে কথা বলেছেন, তা জানা যায়নি।
মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি কার্যকর ও ফলাফলমুখী বিমসটেকের ওপর গুরুত্ব আরোপ
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন গতকাল ব্যাংককে বিমসটেকের ২০তম মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন। সেখানে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে বাস্তব এবং ফলাফলমুখী সহযোগিতার ওপর জোর দেওয়া হয়। বিশেষ করে বিমসটেক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) কার্যকর বাস্তবায়নের মাধ্যমে আন্তঃআঞ্চলিক বাণিজ্য বাড়ানোর বিষয়ে বলা হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তাঁর বক্তব্যে বিমসটেকে সম্মিলিত শান্তি, অগ্রগতি এবং সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি তুলে ধরেন। তিনি বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ১২ লাখ রোহিঙ্গার বিষয়ে উত্থাপন করার পাশাপাশি মিয়ানমার থেকে জোর করে বাস্তুচ্যুত নাগরিকদের অধিকার ও নিরাপত্তার সঙ্গে তাদের নিজ দেশে স্থায়ীভাবে ফেরতের জন্য মিয়ানমারে একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরির ওপর জোর দেন।
বৈঠকে বিমসটেকের ষষ্ঠ শীর্ষ সম্মেলনের জন্য খসড়া অস্থায়ী এজেন্ডা এবং শীর্ষ সম্মেলন ঘোষণার খসড়াও চূড়ান্ত করা হয়। যা আজ অনুষ্ঠেয় শীর্ষ সম্মেলনে বিবেচনা করা হবে।
বিমসটেকের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ঢাকায় ২১তম বিমসটেক মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক আয়োজনে সম্মত হয়েছেন। ২০তম বিমসটেক মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকের প্রতিবেদন নেওয়ার মাধ্যমে বৈঠকটি শেষ হয়।