মানবিক করিডোরের আড়ালে ষড়যন্ত্র এবং আমাদের ভবিষ্যৎ।

Spread the love

                                                                             সম্পাদকীয়:

আধুনিক বিশ্বে মানবিকতা একটি গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবোধ, যা জাতিসংঘ সনদ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত অঞ্চলে আটকে পড়া সাধারণ মানুষের জন্য ‘মানবিক করিডোর’ গঠন একটি নৈতিক ও কৌশলগত দায়িত্ব হিসেবেই বিবেচিত হয়ে এসেছে। কিন্তু সম্প্রতি বিশ্ব রাজনীতিতে মানবিক করিডোর ব্যবহৃত হচ্ছে ভিন্ন উদ্দেশ্যে—সামরিক সুবিধা, ভৌগোলিক দখল এবং গোপন এজেন্ডা বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবে। এর ফলে প্রশ্ন উঠছে—এই করিডোর কি সত্যিই মানবিক, নাকি এর আড়ালে লুকিয়ে আছে এক সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র?

মানবিক করিডোর সাধারণত এমন একটি পথ বা এলাকা, যা যুদ্ধ বা সংকটের সময় নাগরিকদের নিরাপদে সরিয়ে নিতে ব্যবহৃত হয়। এটি নিরপেক্ষ ও অরাজনৈতিক হওয়ার কথা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, অনেক সময় এই করিডোর ব্যবহার করা হচ্ছে বিপক্ষ শক্তির গোয়েন্দা কার্যক্রম, অস্ত্র পরিবহন, বা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর পুনঃবিন্যাসের জন্য। উদাহরণস্বরূপ, মধ্যপ্রাচ্যের কিছু সংঘাতপ্রবণ অঞ্চলে মানবিক করিডোর ঘোষণার পরই শুরু হয়েছে সীমান্তে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন বা বিশেষ এলিট বাহিনীর মোতায়েন। এটা কেবল যুদ্ধের নিয়মের লঙ্ঘন নয়, এটি এক ধরনের কূটনৈতিক ছলচাতুরী, যা মানবিকতার ছদ্মবেশে চলছে।

এই ধরনের কৌশল বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল ও কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর জন্যও একটি সতর্ক সংকেত। দক্ষিণ এশিয়া একটি ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার কেন্দ্রস্থলে রূপ নিচ্ছে। আমাদের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে কোনো ‘মানবিক করিডোর’ বা তথাকথিত সহায়তা চ্যানেল যদি গড়ে তোলা হয়, তা নজরদারির পাশাপাশি আমাদের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকিও হতে পারে। আমরা ইতিহাস থেকে দেখেছি, ‘সহযোগিতা’ বা ‘সহায়তা’র নামে কীভাবে পরাশক্তিগুলো নিজেদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেছে।

এছাড়া, প্রযুক্তির প্রসারের কারণে এই ধরণের ষড়যন্ত্র এখন আরও সূক্ষ্ম ও প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে। করিডোরের আড়ালে ব্যবহার হচ্ছে ড্রোন, স্যাটেলাইট নজরদারি, ডিজিটাল গোয়েন্দাগিরি—যা কেবল একটি অঞ্চল নয়, গোটা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা কাঠামোকে দুর্বল করে দিতে পারে। এ কারণেই আমাদের ভবিষ্যৎ নিরাপদ রাখতে হলে শুধু সামরিকভাবে নয়, কূটনৈতিকভাবে, তথ্যপ্রযুক্তিগতভাবে এবং জনগণের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টির দিকেও গুরুত্ব দিতে হবে।

মানবিকতা অবশ্যই রক্ষা করতে হবে, কিন্তু সেই মানবিকতাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে যে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তৃত হচ্ছে, তা বুঝে নেওয়াও জরুরি। আমাদের কূটনৈতিক নেতৃত্ব, নিরাপত্তা বাহিনী এবং সংবাদমাধ্যমকে হতে হবে আরও সংবেদনশীল, বিশ্লেষণধর্মী এবং স্বার্থ-সচেতন।

উপসংহার:
মানবিক করিডোর একটি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা হতে পারে, তবে এটি যেন ষড়যন্ত্রের হাতিয়ার না হয়ে ওঠে, তা নিশ্চিত করা আমাদের সকলের দায়িত্ব। আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এ বিষয়ে সময়োচিত ও বাস্তবভিত্তিক সিদ্ধান্তের ওপর। শুধু প্রতিক্রিয়াশীল হলে চলবে না, প্রয়োজন দূরদৃষ্টি, সচেতনতা ও সুসংহত কৌশল।


Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *