রেকর্ড গড়লো মেহেরপুর চিফ আদালত, ৫ মাসে ২২৫ মামলা নিষ্পত্তি

Spread the love

মেহেরপুর, করেসপন্ডেন্ট।

সকাল সাড়ে ১১টা থেকে দুপুর ২টা। মেহেরপুর জজ আদালত ভবনের সিঁড়ি দিয়ে দ্বিতীয় তলায় উঠতেই একটি বিচারিক আদালতের সামনে করিডরে দেখা গেল মানুষের উপচেপড়া ভিড়। সাধারণত, বড় কোনো মামলার রায়ের দিন উৎসুক মানুষের এমন ভিড় থাকে।

কারণ জিজ্ঞেস করতেই পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সী আমিনা হালসানা স্বস্তির সুরে বললেন, ‘১০ বচুর আগির কেচ, কতবার সাক্ষী এনিচি, ঘোরৎ দিইচে। ইবার ৩ সাক্ষী এনিচি, ঘোরৎ দেয়নি। ইবার সাক্ষী নিইলে কেচ শেষ হবি।’

উঁকি দিয়ে আদালতের ভেতরে তাকাতেই দেখা গেল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বসা। দরজায় পাহারারত পুলিশ সদস্যকে প্রশ্ন করলে তিনি জানালেন, বিভিন্ন মামলার সরকারি সাক্ষী দিতে তারা দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আদালতে এসেছেন। অর্থাৎ ভেতরে বাইরে সাক্ষীদের উপস্থিতিতে ভরা মেহেরপুর মুখ্য বিচারক হাকিম শাহজাহান আলীর আদালত।

এ সময় আইনজীবীদের দেখা গেল ‘হন্তদন্ত’ অবস্থা। এ কোর্ট থেকে ও কোর্টে ছুটাছুটি। তবে, অধিকাংশের গন্তব্য চিফ আদালতের দিকে। সুষ্ঠু বিচারের স্বার্থে একদিনে এত সাক্ষী করানো সম্ভব কিনা প্রশ্ন করতেই একজন আইনজীবী বললেন, চিফ স্যার সাক্ষীর প্রশ্নে জিরো টলারেন্স। যত সাক্ষী আসুক, যত বেলায় হোক তিনি সব সাক্ষী জেরা নিয়ে প্রতিদিন আদালত শেষ করেন।

তিনি বলেন, সব কোর্ট সামলে এত সাক্ষী আইনজীবীদের জন্য চাপ হলেও নতুন বিচারকের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে এই আদালতে প্রচুর মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে। এতে বিচারপ্রার্থী মানুষের হয়রানি কমছে। মানুষ খুশি মন নিয়ে বাড়ি ফিরছে।

মেহেরপুর চিফ জুডিশিয়াল আদালত সূত্রে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, তেমনই অবাক করা তথ্য। সংশ্লিষ্ট আদালত সূত্র জানায়, সাক্ষী জেরা শেষ করে গত ৫ মাসে এই আদালত ২২৫টি মামলা নিষ্পত্তি করেছে, যা রেকর্ড।

সূত্র জানায়, ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে যেখানে ৫টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে, সেখানে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ২৪টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। একইভাবে ২৪ এর মার্চে ১৮টি, ২৫ সালের মার্চে ৬২টি। ২৪’র এপ্রিলে ৯টি, ২৫’র এপ্রিলে ৫৭টি। ২৪ এর মে মাসে ১৮টি, সেখানে ২৫ এর মে মাসে ৫৯টি। সর্বশেষ জুন মাসে ২৬ তারিখ পর্যন্ত এই আদালতের মামলা নিষ্পত্তির সংখ্যা ছিল ২৩টি, যা ২৪ সালে ছিল ১১টি। সবমিলিয়ে ২৪ সালের এই ৫ মাসে যেখানে মামলা নিষ্পত্তি সংখ্যা ৬১টি। সেখানে ২৫ সালে উল্লেখিত ৫ মাসে মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে ২২৫টি।

তথ্য গ্রহণের সময় উপস্থিত একজন শিক্ষক বললেন, তিনিও সাক্ষী দিতে এসেছিলেন। ৫ বছর পর তিনি সাক্ষী দিয়ে পেরে খুবই খুশি। তিনি বললেন, এভাবে সাক্ষী জেরা সম্পন্ন হলে আদালতে মামলা জট যেমন কমে আসবে। তেমনি বিচারপ্রার্থীরা দ্রুত বিচার পাবে।

আদালতে মামলা নিষ্পত্তির হিড়িক কীভাবে সম্ভব প্রশ্নে মেহেরপুর জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পিপি সাইদুর রাজ্জাক বলেন, ‘মাত্র ৫ মাস হলো নতুন মুখ্য বিচারক হাকিম স্যারের আসা। ফ্যাসিস্ট আমলে সরকারি কৌঁসুলিরা সাক্ষী গেলে সাক্ষী নেয়নি। মামলা নিষ্পত্তি প্রশ্নে বিচারকদের মধ্যেও ছিল অনীহা। এখন সরকারি কৌঁসুলি, পেশকার এবং বকশিদের দ্রুত সাক্ষী সমন পাঠিয়ে এবং সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ করতে কড়া নির্দেশ রয়েছে।

তিনি বলেন, চিফ জুডিশিয়াল আদালতের বিচারক শাহজাহান আলী স্যারের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা ছাড়া এই রেকর্ড গড়া কোনোক্রমেই সম্ভব ছিল না।

মেহেরপুর জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি মারুফ আহমেদ বিজন বলেন, প্রতিদিন সব বিচারিক আদালতে সাক্ষীদের উপস্থিতি বাড়ছে। বিশেষ করে মুখ্য বিচারিক কোর্টে। আইনজীবীদের কাছে এটা চাপ হলেও দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির স্বার্থে এই চাপ সামলাতে হবে আইনজীবীদের।

তিনি বলেন, বার এবং বেঞ্চের পারস্পরিক চেষ্টা ও আন্তরিকতায় আইনজীবীরাও দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির প্রশ্নে বদ্ধপরিকর। তিনি মুখ্য বিচারকি হাকিম আদালতে মামলা নিষ্পত্তির এই সংখ্যাকে নজিরবিহীন বলে দাবি করেন।

মেহেরপুর জেলা জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের আহ্বায়ক আসাদুল আযম খোকন বলেন, ফ্যাসিস্ট আমলে আদালতের শৃঙ্খলা ছিল না। আদালত চলতো খেয়ালখুশি মত। বিচারপ্রার্থীদের কাছে বিচার পাওয়া ছিল আলাদীনের চেরাগ পাওয়ার মত। এখন পরিস্থিতি বদলেছে। মানুষ দ্রুত ন্যায্য বিচার পাচ্ছে। তাই বিচারাঙ্গনের প্রতি বিচারপ্রার্থী মানুষের আস্থা বেড়েছে। ফলে সাক্ষীরাও সমন পাওয়া মাত্র স্বেচ্ছায় আদালতে উপস্থিত হচ্ছেন। আদালত কোনো সাক্ষীকে ফেরত না দিয়ে সাক্ষ্য ও জেরা ধৈর্য সহকারে গ্রহণ করছেন।

তিনি বলেন, বিচারপ্রার্থী মানুষের এই আস্থাকে ধরে রাখতে জাতীয়তাবাদী প্রতিটি আইনজীবী এক্ষেত্রে আদালতকে সম্পূর্ণরূপে সহযোগিতা করছেন বিধায় মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে এখন মামলা নিষ্পত্তির সংখ্যা বেড়ে রেকর্ড গড়েছে।


Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *