কুষ্টিয়ায় পাট চাষে বিপর্যয়: উৎপাদন খরচ বাড়ছে, বিক্রি করে মিলছে না খরচের টাকা—সংকটে পাট চাষীরা

Spread the love

আক্তারুল ইসলাম, কুষ্টিয়া।

কুষ্টিয়ার পাট চাষীরা ন্যায্য দাম না পাওয়ায়, উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি এবং প্রয়োজনীয় সহায়তার অভাবে ক্রমেই পাট চাষে অনাগ্রহী হয়ে পড়ছেন। চলতি বছর জেলার পাটের আবাদ কিছুটা কমেছে। কৃষকদের দাবি, প্রতি বিঘায় ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা খরচ হলেও বিক্রি করতে হচ্ছে ১৫ হাজার টাকারও কম দামে, ফলে প্রতি বিঘায় লোকসান গুনতে হচ্ছে গড়ে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা। এ পরিস্থিতিতে অনেকেই বিকল্প ফসলের দিকে ঝুঁকছেন।

জানা গেছে, গত বছর কুষ্টিয়ায় ৩৫ হাজার হেক্টর জমিতে পাট চাষ হলেও এ বছর আবাদ হয়েছে প্রায় ৩৪ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমিতে। কৃষকরা বলছেন, ক্রমবর্ধমান খরচ ও লোকসানের কারণে জমির পরিমাণ কমেছে। তাছাড়া, বাজারে ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

মিরপুর উপজেলার কৃষক আব্দুল বারী বলেন, প্রতি বিঘা জমিতে বীজ, সার, শ্রমিক মজুরি, সেচসহ সব মিলিয়ে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা খরচ হয়। কিন্তু বাজারে গিয়ে দেখা যায়, আমাদের পাট ১৫ হাজার টাকায়ও বিক্রি হচ্ছে না। এতে প্রতি বিঘায় ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত লোকসান হচ্ছে। এভাবে আর পাট চাষ করা সম্ভব নয়।

একই এলাকার আরেক কৃষক জসিম উদ্দিন বলেন, আমরা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করি, আবার বাজারে গিয়েও ক্ষতির মুখে পড়ি। পাটের জন্য কোনো প্রণোদনা নেই, কৃষি কর্মকর্তারা মাঠে এসে আমাদের খোঁজখবরও তেমন নেন না।

কৃষকদের অভিযোগ, বর্তমান বাজারদর ও উৎপাদন খরচের মধ্যে বিরাট ফারাক রয়েছে। তাছাড়া, পাটের মান বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় আধুনিক পদ্ধতি ও প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগও সীমিত।

পাট চাষীরা দাবি করছেন, সরকারের পক্ষ থেকে সরাসরি পাট ক্রয়ের ব্যবস্থা করা, উৎপাদন খরচের তুলনায় ন্যায্য মূল্য নির্ধারণ করা এবং প্রয়োজনীয় প্রণোদনা দেওয়া জরুরি। এতে পাট চাষে আগ্রহ বাড়বে এবং কৃষকের ক্ষতি কমবে।

পাট চাষি মিনাজুল ইসলাম বলেন, পাট বাংলাদেশের ঐতিহ্য। অথচ এখন আমরা লোকসান গুনে এই ফসল চাষ করছি। যদি সরকার ন্যায্য দাম নিশ্চিত করে, তাহলে পাট চাষে আমরা আবার মনোযোগী হবো।

কুষ্টিয়ায় পাট চাষে বিপর্যয়
কুষ্টিয়ায় পাট চাষে বিপর্যয়

এ প্রসঙ্গে কুষ্টিয়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা সুফি ম. রফিকুজ্জামন বলেন, আমরা কৃষকদের খরচ বাঁচাতে সব ধরনের পরামর্শ দিচ্ছি। সেচ, সার, এবং কীটনাশক ব্যবহারে সাশ্রয়ী পদ্ধতি অনুসরণ করতে বলা হচ্ছে। তবে বাজারদর নির্ধারণে কৃষি বিভাগ সরাসরি ভূমিকা রাখে না।

পাট চাষের খরচ বেড়ে যাওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে—বীজ ও সারের দাম বৃদ্ধি, শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি, সেচের খরচ বেড়ে যাওয়া, পাট কাটাই ও জাগ দেওয়ার ব্যয় বৃদ্ধি

এছাড়া, আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় অনেক ক্ষেত্রেই উৎপাদন প্রত্যাশিত হয়নি, যা কৃষকের লোকসান আরও বাড়িয়েছে।

পাট বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হলেও স্থানীয় কৃষকের আর্থিক সংকট এর টেকসই উৎপাদনকে হুমকির মুখে ফেলছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি কৃষকরা পাট চাষে অনাগ্রহী হয়ে পড়েন, তাহলে ভবিষ্যতে পাটশিল্প কাঁচামালের ঘাটতিতে পড়তে পারে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বলেন, পাটের দাম স্থিতিশীল না হলে কৃষকরা বিকল্প ফসলের দিকে ঝুঁকবেন, যা দেশের পাটশিল্পের জন্য দীর্ঘমেয়াদে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, পাট চাষ টিকিয়ে রাখতে—সরকার বা সংশ্লিষ্ট সংস্থা সরাসরি পাট ক্রয়ের উদ্যোগ নিতে পারে। পাবেন। রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণ আন্তর্জাতিক বাজারে পাটের চাহিদা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। বীজ, সার ও সেচে ভর্তুকি প্রদান করা। সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণ অবকাঠামো উন্নয়নে আধুনিক গোডাউন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র স্থাপন করলে কৃষকরা ভালো দাম পাবে।

ঐতিহ্য রক্ষার আহ্বান- পাট শুধু একটি অর্থকরী ফসল নয়, এটি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ। একসময় “সোনালী আঁশ” নামে পরিচিত পাট দেশের অর্থনীতিতে বিশাল অবদান রেখেছিল। বর্তমান প্রজন্মের কৃষকদের সেই ঐতিহ্য ধরে রাখতে প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা, ন্যায্য দাম এবং নীতিগত উদ্যোগ।

কুষ্টিয়ার কৃষকদের আশা, সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ ও বাজারদরের উন্নয়নের মাধ্যমে তারা আবারও লাভজনকভাবে পাট চাষ করতে পারবেন।

 


Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *