ধর্মপ্রাণ জনপদে জুয়ার হাহাকার, প্রশাসনের হস্তক্ষেপে অবসান

Spread the love

কক্সবাজার প্রতিনিধি।

কয়েকদিন ধরে কক্সবাজারের রামু উপজেলার দক্ষিণ মিঠাছড়িতে চলছিল এক ‘বৈধতার মুখোশ পরা অবৈধতার উৎসব’। বৈশাখী মেলার নামে ঐতিহ্যবাহী বলী খেলার আড়ালে গড়ে তোলা হয় এক ভয়াবহ জুয়ার আসর। স্থানীয় বাসিন্দাদের বর্ণনায়- এটি ছিল ‘একটি প্রকাশ্য জুয়ার সাম্রাজ্য’, যেখানে শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ পর্যন্ত জড়িয়ে পড়েছিলেন অর্থ হারানোর নেশায়।

আয়োজক হিসেবে উঠে আসে ইউনিয়ন যুবদলের আহ্বায়ক আব্দুল্লা ভুট্টোর নাম, যিনি প্রশাসনের ‘নীরব সমর্থন’ এবং পুলিশের ‘নিখুঁত নিরাপত্তা’ নিয়ে এ আয়োজন চালিয়ে যাচ্ছিলেন বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।

ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের অভিযোগ, তারা জুয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালে বিভিন্ন ধরনের হুমকির মুখে পড়তে হয়। এসব প্রতিবাদ উপেক্ষা করে শক্তি প্রদর্শনের অংশ হিসেবে যুবদল নেতা আব্দুল্লা ভুট্টো নিজের ফেসবুক পেজে বলী খেলার অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার করেন।

অভিযোগ উঠেছে, স্থানীয় ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের আকুতি, শিক্ষক-ইমামদের প্রতিবাদ, শিশুদের কান্না আর সচেতন নাগরিকদের সরব প্রতিক্রিয়ার পরেও থামেনি বলী খেলার আড়ালে এই জুয়ার আয়োজন। কেউ বলেন ‘টাকার খেলা’, কেউ বলেন ‘রাজনৈতিক ছায়ায় গজিয়ে ওঠা অনৈতিক উৎসব’- নাম যাই হোক, বাস্তবতা একটাই: দক্ষিণ মিঠাছড়ি এক সপ্তাহ ধরে ছিল জুয়াড়িদের দখলে।

বুধবার (১৪ মে) বিকেলে স্টেশনে ১০–১২টি স্টলে চলছিল জমজমাট জুয়া। স্থানীয় সাংবাদিকরা ভিডিও ও ছবি সংগ্রহ করেছেন, যেখানে দেখা যায়—নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরাও রয়েছেন মাঠে, তবে জুয়া বন্ধ করতে নয়; বরং উৎসব নির্বিঘ্ন করতে।

অবশেষে শুক্রবার (১৬ মে) বিকেলে রামুর সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাজ্জাতুল রাতুল মাঠে নামেন। তার নেতৃত্বে পরিচালিত অভিযানে বন্ধ হয়ে যায় এই আয়োজন। কিন্তু এই পদক্ষেপ দেরিতে নেওয়া—এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।

দুই শত বছরের ধর্মীয় ও সামাজিক ঐতিহ্যকে ভেঙে দিয়ে দক্ষিণ মিঠাছড়িতে জুয়ার আসর বসানোর অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় যুবদল নেতা আব্দুল্লা ভুট্টোর বিরুদ্ধে। ধর্মপ্রাণ এই এলাকায় বলী খেলার নামে জুয়ার আয়োজন করে ক্ষমতা ও পেশিশক্তির প্রভাব খাটিয়ে ভুট্টো চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন স্থানীয় মূল্যবোধের প্রতি। অবশেষে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে জুয়ার আসর বন্ধ হওয়ায় স্বস্তি প্রকাশ করেছেন এলাকাবাসী।

তবে এই অবৈধ আয়োজন বন্ধে রামু থানার ওসি ইমন কান্তি চৌধুরীর ভূমিকা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। স্থানীয়দের অভিযোগ, ওসি ইমন কান্তি ক্ষমতাবানদের তুষ্ট করতে জুয়ার বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেননি; বরং উলটো পুলিশ পাঠিয়ে আয়োজনকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন। এতে স্থানীয়দের ক্ষোভ যেমন তীব্র হয়েছে, তেমনি প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়েও উঠেছে জোরালো প্রশ্ন।

অবশেষে সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাজ্জাতুল রাতুলের নেতৃত্বে অভিযান চালিয়ে জুয়ার আসর বন্ধ করায় প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন এলাকাবাসী।

স্থানীয় এক মাদ্রাসা শিক্ষক বলেন, “এতদিন ধরে চলল, এত মানুষ অভিযোগ করল—কিন্তু কেউ নড়ল না। এসিল্যান্ড সাহেব না এলে এটা আজও বন্ধ হতো না।”

একজন প্রবীণ মুরুব্বি বলেন, “প্রশাসনের কেউ যদি শুরুতেই পদক্ষেপ নিতেন, তাহলে এত মানুষের ঈমান, সময় আর টাকা নষ্ট হতো না।”

প্রতিবাদকারী তরুণদের ভাষ্য, প্রশাসন অনেক আগে থেকেই জানত এ আয়োজনের ব্যাপারে। শুধু জানতই না, বরং অনেকেই নীরব সমর্থন দিয়ে গেছেন। স্থানীয় দোকানদার, পথচারী, এমনকি আয়োজনে থাকা স্টল মালিকরাও স্বীকার করেছেন- পুলিশ নিয়মিত টহল দিয়েছে, জুয়ার টাকায় সুবিধা পেয়েছে অনেকে।

এই আয়োজনের মূল হোতা আব্দুল্লা ভুট্টো সম্পর্কে জানা গেছে, তিনি স্থানীয় এক নেতার ঘনিষ্ঠ। ফলে তার বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস পায় না কেউ। এমনকি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান খুদেস্তা রীনা পর্যন্ত দায় এড়িয়ে বলেছেন, “আয়োজকরা জানিয়েছে প্রশাসনের অনুমতি আছে, সেই বিশ্বাসে মৌখিক অনুমতি দিয়েছি।”

স্থানীয় ছাত্রদল নেতা সাঈদ হোসাইন আকাশ বলেন, “ধর্মপ্রাণ মিঠাছড়িবাসীর পক্ষে আমরা তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছি। বলী খেলার নাম ভাঙিয়ে কেউ জুয়ার আসর বসালে, তা মেনে নেওয়া যায় না। আমাদের প্রতিবাদ আমলে নিয়ে খেলা বন্ধ করায় আমরা উপজেলা প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানাই।”

অন্যদিকে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের একজন বলেন, “এই জুয়ার মেলা বন্ধ না হলে, আমাদের তরুণ সমাজ ধ্বংস হয়ে যাবে। এটা শুধু একটি আয়োজন নয়, একটি প্রজন্মকে গ্রাস করার হাতিয়ার।”

স্থানীয়দের মতে, এটি একটি নিছক বলী খেলার আয়োজন নয়। এটি ছিল প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে রাজনৈতিক ছায়ায় বেড়ে ওঠা একটি অপরাধচক্রের উন্মোচন। যেখানে ‘ঐতিহ্য’, ‘উৎসব’ কিংবা ‘মৌখিক অনুমতি’র আড়ালে লুকিয়ে ছিল টাকা, প্রভাব ও নৈতিক অবক্ষয়ের নগ্ন প্রদর্শনী।


Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *