
নিউজ ডেস্ক, জনতারকথা, ঢাকা।
পুনঃআরোপিত পাল্টা শুল্কের প্রভাব ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতসহ রপ্তানিমূখি শিল্পে। বাংলাদেশের পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের পুনঃ আরোপিত ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক ঘোষণার পরই দেশের পোশাকশিল্প সংশ্লিষ্টরা নড়েচড়ে বসেছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, ইতোমধ্যে বাংলাদেশ থেকে পোশাক ক্রয়াদেশ কমিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানিকারক বিভিন্ন বড় কোম্পানি।
দেশের রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশের বেশি আসে তৈরি পোশাক থেকে। সেই পোশাকশিল্পের রপ্তানির একক দেশ হিসেবে সবচেয়ে বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র। পোশাকশিল্প থেকে রপ্তানি আয় হয় ৩৯ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার। দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয় যুক্তরাষ্ট্রে। এর মধ্যে ৭ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার আসে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে।
কারখানা মালিকরা জানান, আগামী ১ আগস্ট থেকে ট্রাম্প প্রশাসনের প্রস্তাবিত শুল্ক কার্যকর হলে ক্রয়াদেশ কমে যাবে। কারণ ৩৫ শতাংশ অতিরিক্ত খরচ তারা বহন করতে পারবেন না। প্যাট্রিয়ট ইকো অ্যাপারেল লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইকবাল হোসেন জানান, যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত শুল্কের কারণে ওয়ালমার্টের জন্য প্রায় ১০ লাখ সাঁতারের পোশাকের একটি ক্রয়াদেশ গত বৃহস্পতিবার স্থগিত করা হয়েছে।
এমনকী, বিশ্বখ্যাত ওয়ালমার্টও বাংলাদেশের পোশাকের কিছু ক্রয়াদেশ পিছিয়েছে এবং কিছু ক্রয়াদেশ স্থগিত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশের পণ্যে ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করার ঘোষণা দেওয়ায় এমন ঘটনা ঘটল। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক খবরে এ তথ্য জানা যায়। এতে বলা হয়, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানিতে তৃতীয় বৃহত্তম দেশ এবং দেশটির রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশ এবং মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১০ শতাংশ এ খাত থেকে আসে।
সরকার যদি শুল্ক কমাতে না পারে তবে শুধু অর্ডার হ্রাস নয়, এর ফলে শ্রমিকের মজুরি, কর্মসংস্থান ও সামাজিক স্থিতিশীলতা সবই ঝুঁকিতে পড়তে পারে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এখনই ব্যবস্থা না নিলে শুধু অর্ডার নয়, বরং বিশ্বমঞ্চে এই দেশের তৈরি পোশাক খাতের দীর্ঘদিনের অর্জন ও ভাবমূর্তি চিরতরে হারিয়ে যেতে পারে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের ২ হাজার ৩৭৭টি প্রতিষ্ঠান তাদের পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাড়তি শুল্ক আরোপে এসব প্রতিষ্ঠান বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা জানান, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাকের চাহিদা দিন দিন বাড়ায় বিনিয়োগ বাড়িয়েছেন ব্যবসায়ীরা। পোশাক রপ্তানিকারকরা নতুনভাবে উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি করায় এসব বিনিয়োগ এখন হুমকির মুখে।
বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, ট্রাম্পের শুল্ক একটি চক্রাকার আকারে প্রভাবিত হবে। এতে সবাই ভোগান্তিতে পড়বে। ন্যূনতম শুল্ক বাড়লেও সবাই আক্রান্ত হবে। শুল্ক বাড়ার ফলে ভোক্তার কাছে পণ্যের দাম বাড়বে। এতে বিক্রি সাময়িকভাবে কমে যেতে পারে। শুল্কের এ চাপ সবাই সবার ওপর চাপানোর চেষ্টা করবে।
বাংলাদেশের পোশাকশিল্পকে ধ্বংস করার জন্য ট্রাম্পের আরোপ করা ট্যারিফই যথেষ্ট মন্তব্য করে বাংলাদেশ গার্মেন্ট বায়িং হাউস অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য ও ইউনাইটেড ফোরামের প্যানেল লিডার মোহাম্মদ মফিজ উল্লাহ বাবলু বলেন, বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনীতি যে শক্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে তা হলো পোশাক খাত। বাংলাদেশি পণ্যের ওপর আগে থেকেই গড়ে ১৫ শতাংশের বেশি শুল্ক আরোপিত ছিল। এর সঙ্গে নতুন ৩৫ শতাংশ শুল্ক যোগ হলে মোট শুল্কের হার ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। এত শুল্ক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আমরা কোনোভাবেই পোশাক রপ্তানি করতে পারব না। এর ফলে পোশাকশিল্পের সবচেয়ে বড় বাজার আমরা হারাব।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আলোচনার তৃতীয় ও শেষ দিনে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানিয়েছে, বাংলাদেশ এবং ওয়াশিংটন আরও কিছু বিষয়ে একমত হয়েছে, যদিও কিছু বিষয় এখনও অমীমাংসিত রয়ে গেছে। এই লক্ষ্যে উভয় পক্ষই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ঢাকা ও ওয়াশিংটনের মধ্যে আন্তঃমন্ত্রণালয় সংলাপ অব্যাহত থাকবে। দুই দেশের প্রতিনিধিরা ভার্চুয়াল বা সশরীরে আবার আলোচনায় বসবেন। আশা করা হচ্ছে, পরবর্তী পর্যায়ের আলোচনার সময়সূচি খুব শিগগিরই ঠিক করা হবে।
‘বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সদস্য বাণিজ্য উপদেষ্টা, সচিব এবং অতিরিক্ত সচিব আজ দেশে ফিরে আসবেন। প্রয়োজনে তারা আবারও ওয়াশিংটনে যাবেন বৈঠক করতে’ জানিয়েছে প্রেস উইং।
ব্লুমবার্গ নিউজ জানিয়েছে, প্রস্তাবিত শুল্ক ২০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে ভারতের সঙ্গে একটি চুক্তি নিয়ে কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে ভিয়েতনাম প্রাথমিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি অনুকূল চুক্তি নিশ্চিত করেছে।
এদিকে, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সভাপতি হাসান মাহমুদ বাবু বলেছেন, ২০ শতাংশ মার্কিন শুল্ক শর্তের বিষয়ে ঢাকা-ওয়াশিংটন এখনও একমত হয়নি। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি পারস্পরিক শুল্ক হার ৩৫% থেকে কমিয়ে ১৫% করতে সম্মত হয়, তাহলে আমরা ৪০% মূল্য সংযোজন মেনে নিতে রাজি।
এই ব্যবসায়ী নেতা আরও বলেন, ‘বৈঠকে আমাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। আমাদের অন্ধকারে রাখা হয়েছিল এবং বৈঠকের আগের রাতে আমাদের কিছু মতামত চাওয়া হয়েছিল। আমরা মতামত দিয়েছি। বৈঠক শেষে, আমাদের বলা হয়, বাংলাদেশের উপর আরোপিত পারস্পরিক শুল্ক হার ৩৫% থেকে কমিয়ে আনা হবে।’
বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং চীন থেকে আমদানি কমানোর শর্ত সম্পর্কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ সম্পর্কে জানতে চাইলে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, ‘আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া শর্ত সম্পর্কে কিছুই জানি না। সরকার এই বিষয়ে কিছু জানাতে পারছে না কারণ তাদের একটি অপ্রকাশ্য চুক্তি রয়েছে।’
তবে পলিসি এক্সচেঞ্জ এর চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ বলেন, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে আরও প্রতিযোগিতামূলক হওয়ার জন্য ব্যবসার ব্যয় হ্রাস করে দক্ষতা উন্নত করার কোন বিকল্প নেই।