
স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট।
বাংলাদেশি পণ্যে যুক্তরাষ্ট্র ঘোষিত ৩৫ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হলে সহসাই বন্ধ হয়ে যেতে পারে দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি পোশাক কারখানাগুলো। বন্ধের ঝুঁকিতে থাকা এমন সহস্রাধিক কারখানার অন্তত ১০ লাখ শ্রমিক কর্মহীন হওয়ার আশঙ্কা করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। গণমাধ্যমকে দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা এমন আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন।
রপ্তানিকারক ও বাণিজ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে গড়ে ১৬ শতাংশ (১৫.৬২%) শুল্ক দিয়ে বাংলাদেশি পণ্য প্রবেশ করে। ট্রাম্পের বাড়তি শুল্ক কার্যকর হলে তখন মোট ৫১ শতাংশ শুল্ক দিতে হবে। বাংলাদেশি রপ্তানি পণ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বাড়তি শুল্ক আরোপ বড় ধরনের অর্থনৈতিক আঘাত, বিশেষ করে তৈরি পোশাকশিল্পের জন্য। আগে যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কহার ছিল প্রায় ১৬ শতাংশ, এখন তা তিন গুণেরও বেশি। এই হঠাৎ ও ব্যাপক শুল্ক বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের রপ্তানি খাত, বিশেষ করে তৈরি পোশাকের রপ্তানি বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে পাল্টা শুল্কারোপ ইস্যুতে বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশির উদ্দিনের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তিন দিনের বৈঠক শেষে শুল্ক কমানোর বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। বরং এমন কিছু কঠিন শর্ত দেওয়া হয়েছে, যা বাংলাদেশের পক্ষে মানা কঠিন। ফলে দেশের ব্যবসায়ী- শিল্পোদ্যোক্তাদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ বিরাজ করছে।
পোশাক রপ্তানিকারকরা জানিয়েছেন, বছরে ৫ মিলিয়ন ডলার পণ্য রপ্তানি করে, এমন পোশাক কারখানার সংখ্যা ৪৫০। এগুলো ছোট কারখানা হিসেবে পরিচিত। এসব কারখানায় গড়ে শ্রমিক কাজ করেন ৭০০ জন। ফলে মোট শ্রমিক সংখ্যা দাঁড়ায় সোয়া তিন লাখের মতো। অন্যদিকে মাঝারি হিসেবে পরিচিত কারখানার সংখ্যা ৭০০। এগুলো বছরে ৫ থেকে ২০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে। এসব কারখানায় গড়ে এক হাজার শ্রমিক কাজ করেন। ফলে মাঝারি কারখানায় প্রায় সাত লাখ শ্রমিক কাজ করছেন, যার বড় একটি অংশ নারী।
বিজিএমইএ সূত্র বলেছে, ছোট-মাঝারি মিলে ১ হাজার ১০০-এর বেশি কারখানায় ১০ লাখ শ্রমিক কাজ করছেন। বাড়তি শুল্ক কার্যকর হলে এসব কারখানা বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়ায় আশঙ্কা করা হচ্ছে। পোশাক রপ্তানিকারকরা বলেছেন, ছোট-মাঝারি কারখানাগুলোর সক্ষমতায় ঘাটতি আছে। বাড়তি শুল্কের চাপ এসব প্রতিষ্ঠান সামাল দিতে পারবে না। ফলে ক্রয়াদেশ বা অর্ডার পাবে না তারা। ক্রয়াদেশ না পেলে কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হবে। চাকরি হারাবেন লাখ লাখ শ্রমিক।
বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, বাড়তি শুল্ক আরোপের ফলে সব কারখানাই কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে সবচেয়ে বড় ধাক্কা আসবে ছোট ও মাঝারি কারখানাগুলোতে। তিনি আরও বলেন, যেকোনো ফ্যাক্টরি ২০ থেকে ৩০ শতাংশ ক্রয়াদেশ না পেলে সেই প্রতিষ্ঠান টিকে থাকতে পারে না। সক্ষমতার অভাবে এসব ফ্যাক্টরি ক্রয়াদেশ পাবে না। তখন প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ প্রধানত যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে কম দামের পোশাক রপ্তানি করে। বাড়তি শুল্কের কারণে ওই সব পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। আমার ধারণা, এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ বিক্রি কমে যাবে। তাতে বড় ধরনের একটা অস্থিরতা তৈরি হবে।’ এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘শেষ পর্যন্ত ফলাফল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, তা বলার সময় এখনো আসেনি। বাংলাদেশকে দর-কষাকষি চালিয়ে যেতে হবে।’
পোশাক মালিকরা বলেছেন, ক্রয়াদেশ সাধারণত দুভাবে আসে। একটি হলো সরাসরি, যা ওয়ালমার্টের মতো বড় বায়ারদের মাধ্যমে। আরেকটি হলো পরোক্ষ বা সরাসরি নয়। অর্থাৎ ইমপোর্টার ও বায়িং হাউসের মাধ্যমে রপ্তানি করা হয়। শতকরা ৫০ ভাগ ক্রয়াদেশ আসে সরাসরি। বাকি ৫০ ভাগ আসে পরোক্ষভাবে। ছোট-মাঝারি কারখানাগুলো সরাসরি রপ্তানি করে না। বাড়তি শুল্কের কারণে এসব প্রতিষ্ঠান সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এর মধ্যে বসন্ত ও গ্রীষ্মকালীন সময়ের জন্য বায়িং হাউস ও ইমপোর্টারের মাধ্যমে যেসব ক্রয়াদেশের প্রস্তাব পাওয়া গেছে তার ২০ থেকে ৩০ শতাংশ ক্রয়াদেশ স্থগিতা করে দেওয়া হয়েছে। রপ্তানিকারকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ওপর বেশি নির্ভরশীলতার কারণে ছোট ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলো বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে।
উদ্যোক্তারা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দর-কষাকষি করে যদি বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশের তুলনায় এই বাড়তি শুল্কহার কমিয়ে আনা যায়, তাহলে উল্টো বাজারটিতে রপ্তানির নতুন সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। তবে প্রতিযোগী দেশের তুলনায় বাংলাদেশের শুল্কহার যদি বেশি হয়, তাহলে এই বাজার ধীরে ধীরে হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। অর্থনীতিতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়তে পারে।