
নিউজ ডেস্ক, জনতারকথা।
বাংলাদেশের উৎপাদন অর্থনীতির জন্য সময়টি শঙ্কা ও উদ্বেগের। বিশ্বঅর্থনীতির মন্দার মাঝেই যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আগ্রাসনে ধুঁকতে থাকা বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন আরও সংকটে। বিগত অর্থবছরের ১১ মাসের (জুলাই-মে) তথ্যে সংকটের প্রকৃত অবস্থা অনেকটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক লেনদেনের ব্যালান্স অব পেমেন্টের (বিওপি) হালনাগাদ পরিসংখ্যানে জানা গেছে, দেশে মূলধনি যন্ত্রের আমদানি কমেছে ১৯ দশমিক ৬ শতাংশ। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এ প্রবণতা দীর্ঘমেয়াদে শিল্প খাতের উৎপাদন সক্ষমতা ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
উদ্যোক্তারা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, কাস্টমসে হয়রানি, ব্যাংক ঋণে অতিরিক্ত সুদের মতো কারণেই মূলত নতুন বিনিয়োগে পা বাড়াচ্ছেন না তারা। যার ফলে কমেছে মূলধনি যন্ত্র আমদানি। আর এতে চাহিদা কমে যাওয়ায় কমেছে ডলারের দাম।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, সদ্য বিদায়ী অর্থবছরের ১১ মাসে (জুলাই-মে) দেশে মূলধনি যন্ত্রের আমদানি কমেছে ১৯ দশমিক ৬ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য বা ব্যালান্স অব পেমেন্টের (বিওপি) হালনাগাদ পরিসংখ্যানে এ তথ্য পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় উদ্যোক্তারা বিনিয়োগমুখী হচ্ছেন না। যার প্রতিফলন হিসেবে দেশে মূলধনি যন্ত্রের আমদানি কমেছে। এর প্রভাবে সামগ্রিকভাবে চাহিদা কমেছে ডলারের। ফলে ডলারের দাম কমে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১০ মাসের (জুলাই থেকে এপ্রিল) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মূলধনি যন্ত্রের এলসি ওপেনিং বা আমদানির লক্ষ্যে ঋণপত্র খোলা কমে যাওয়ার পাশাপাশি ঋণপত্র নিষ্পত্তিতেও ঋণাত্মক বা নেতিবাচক পরিস্থিতি উঠে এসেছে। দেখা যাচ্ছে ১০ মাসে মূলধনি যন্ত্রের এলসি ওপেনিং কমেছে ২৭ দশমিক ৪৬ শতাংশ। নিষ্পত্তি কমেছে ২৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, দেশে আমদানি হওয়া ক্যাপিটাল মেশিনারি বা মূলধনি যন্ত্রের উল্লেখযোগ্য খাতগুলোর মধ্যে রয়েছে টেক্সটাইল, লেদার/ট্যানারি, জুট, গার্মেন্ট, ফার্মাসিউটিক্যাল ও প্যাকিং। ১০ মাসে টেক্সটাইল মেশিনারি আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলা কমেছে ২২ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। এ খাতে ঋণপত্র নিষ্পত্তি কমেছে ২৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ।
লেদার/ট্যানারি খাতে ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলা কমেছে ২৪ দশমিক ৬ শতাংশ। আর ঋণপত্র নিষ্পত্তি কমেছে দশমিক ৫৩ শতাংশ। জুট ইন্ডাস্ট্রির মেশিনারি আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলা কমেছে ৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ। এ খাতে ঋণপত্র নিষ্পত্তি কমেছে ১৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ। এছাড়া ফার্মাসিউটিক্যাল ও প্যাকিং ইন্ডাস্ট্রির মূলধনি যন্ত্র আমদানিও কমেছে।
বাংলাদেশে পুঁজিঘন বিনিয়োগের অন্যতম বড় খাত বস্ত্র। পোশাক খাতের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ এ শিল্পে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ রয়েছে। এ খাতের প্রতিনিধিরা বলছেন, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি ১৯ দশমিক ৬ শতাংশ হ্রাস পাওয়া নিঃসন্দেহে দেশের শিল্প ও বিনিয়োগপ্রবণতার জন্য একটি বড় সতর্কবার্তা। এ প্রবণতা শুধু সাময়িক মন্দার প্রতিফলন নয়, বরং এটি দীর্ঘমেয়াদে শিল্প খাতের প্রতিযোগিতা, উৎপাদন সক্ষমতা এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, ‘মূলধনি যন্ত্রের আমদানি হ্রাস টেক্সটাইল শিল্পের আধুনিকীকরণ, নতুন প্রযুক্তি সংযোজন এবং উৎপাদন বৈচিত্র্যকরণের উদ্যোগকে বাধাগ্রস্ত করছে। বিশেষ করে নন-কটন খাতে যে সম্ভাবনা ও রফতানিমুখী বাজারে প্রবেশের নতুন জানালা তৈরি হয়েছিল তা ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে।’
বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপাতি আমিরুল হক বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের হাতে নগদ অর্থ থাকে না। দ্বিতীয় কারণ, ব্যাংক ঋণের সুদহার ১৪-১৫ শতাংশ। কম্পাউন্ড সুদ মিলিয়ে এ হার গিয়ে দাঁড়ায় ১৭ শতাংশে। এ পরিস্থিতিতে রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট হয় না।’
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের বোর্ড অব গভর্নর্সের সদস্য সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘মূলধনি যন্ত্রের আমদানি আগে থেকেই কমছিল। এটা ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গিয়েছিল। এখন বরং কমার সেই হার কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। ডলারের দাম কমে যাওয়ার পেছনেও এটা অন্যতম কারণ। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে কিছুটা উন্নতি হয়েছে, তার পরও এখানে-সেখানে রাজনৈতিক কিছু ঘটনা ঘটছে।’
তবে তিনি মনে করেন, সবকিছু মিলিয়ে নির্বাচন হয়ে গেলে হয়তো কিছুটা স্ট্যাবিলিটি আসবে। তখন বিনিয়োগ হবে। মূলধনি যন্ত্রের আমদানিও বাড়বে।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, ‘বাংলাদেশের সামগ্রিক আমদানিও কমেছে। আমদানির মাসিক গড় এখন আগের চেয়ে অনেক কম। মূলধনি যন্ত্র আমদানি কমে যাওয়ার অর্থ হলো কাঁচামাল আমদানিও সেই তুলনায় কমে আসবে। ভোগ্যপণ্যের চাহিদাও বাজারে কিছুটা কম আছে। সব মিলিয়ে ডলারের চাহিদা স্বাভাবিকভাবে কমে গিয়ে ডলারের ওপর চাপটাও এখন তুলনামূলক কম। উদ্যোক্তারা শিল্প সক্ষমতা বাড়াতে পারেননি। বরং তারা টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।
‘মানুষ স্ট্যাবল সরকার দেখতে চায়’ মন্তব্য করে এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, ‘ব্যবসাকে সফল করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে যে ধরনের পদক্ষেপ প্রয়োজন তা দৃশ্যমান নয়। বরং উদ্যোক্তারা সবকিছু নেতিবাচক দেখছেন। তারা দেখছেন ব্যাংক আরো কঠিন হচ্ছে। অর্থনীতিতে সংকোচন নীতির প্রয়োগও তারা দেখছেন। কাস্টমসের হয়রানি তো কমেইনি, বরং কাস্টমসের স্ট্যাবিলিটি নিয়ে ব্যবসায়ীরা শঙ্কিত। আবার নির্বাচন নিয়েও সংশয় কাটছে না। মব রয়ে যাচ্ছে। নিরাপত্তা দুশ্চিন্তাও কাটেনি।’