আত্মগ্লানি বনাম অর্থনৈতিক মুক্তি সুদমুক্ত বিকল্প মুদারাবা মুশারাকা

Spread the love

ড. তারনিমা ওয়ারদা আন্দালিব এবং দাউদ ইব্রাহিম হাসান।

আজকের বাংলাদেশে, মসজিদের মিনার থেকে যখন সুদের ভয়াবহতা সম্পর্কে আযানের সুর ভেসে আসে, তখনো অনেক মানুষ জীবনধারণের তাগিদে সুদের কাছেই হাত পাততে বাধ্য হয়। ক্ষুদ্র কৃষক থেকে শুরু করে ছোট ব্যবসায়ী, নিম্নবিত্ত পরিবার—সকলেই যেন এক অদৃশ্য সুতার টানে সুদের জালে জড়িয়ে পড়ে। এটি কেবল অর্থনৈতিক বাধ্যবাধকতা নয়, বরং এক সামাজিক ব্যাধি, যা নৈতিকতার মেরুদণ্ড ভেঙে দিচ্ছে। ইসলামিক শরীয়ত অনুযায়ী সুদকে সুস্পষ্টভাবে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে (আল-কুরআন ২:২৭৫), তবুও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা এবং বিকল্প হালাল উপার্জনের পথের অপ্রাপ্যতা বহু মানুষকে এই হারাম পথে ঠেলে দিচ্ছে। এই বাস্তবতা আমাদের সমাজের গভীরে প্রোথিত একটি গুরুতর সমস্যার দিকে আলোকপাত করে, যেখানে ধর্মীয় অনুশাসন এবং দৈনন্দিন জীবনের চাহিদা এক কঠিন সংঘাতে আবদ্ধ।

এই সংকট শুধু ব্যক্তিগত আর্থিক ক্ষতি নয়, বরং এর পেছনে লুকিয়ে আছে এক সামাজিক অবক্ষয়। যখন একজন মানুষ সুদ গ্রহণ বা প্রদান করতে বাধ্য হয়, তখন তার মধ্যে এক ধরনের আত্মগ্লানি কাজ করে, যা দীর্ঘমেয়াদে তার মানসিক শান্তি এবং নৈতিক অবস্থানকে প্রভাবিত করে। সমাজের এই চিত্র আমাদেরকে এক কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায়: কিভাবে আমরা এমন একটি ব্যবস্থা তৈরি করতে পারি, যা মানুষকে সুদের অন্ধকার পথ থেকে ফিরিয়ে এনে হালাল উপার্জনের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে পরিচালিত করবে? এই প্রশ্নটি কেবল একটি ধর্মীয় জিজ্ঞাসা নয়, বরং একটি কার্যকর অর্থনৈতিক মডেল প্রতিষ্ঠার আহ্বান, যা আমাদের সমাজকে এক নতুন দিশা দেখাতে পারে।

উদাহরণস্বরূপ, একজন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, যিনি এখন উচ্চ সুদে ঋণ নিতে বাধ্য হন, তাকে ব্যাংক মুদারাবা চুক্তির অধীনে মূলধন সরবরাহ করতে পারে। উদ্যোক্তা তার ব্যবসা পরিচালনা করবেন এবং অর্জিত মুনাফার একটি অংশ ব্যাংকের সাথে ভাগ করে নেবেন। এতে উদ্যোক্তার উপর ঋণের বোঝা থাকে না এবং ব্যাংকও হালাল উপায়ে আয় করতে পারে। একইভাবে, বড় প্রকল্পে মুশারাকা চুক্তির মাধ্যমে একাধিক বিনিয়োগকারী অংশগ্রহণ করতে পারে।

এই ধরনের ব্যবস্থা চালু করার জন্য প্রাথমিকভাবে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। প্রথমত, ইসলামিক অর্থায়ন সম্পর্কে ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরি করা। মানুষকে সুদের হারাম হওয়ার কারণ এবং হালাল উপার্জনের বিকল্প পথ সম্পর্কে শিক্ষাদান করা। দ্বিতীয়ত, ইসলামিক ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও শক্তিশালী ও সহজলভ্য করা। তাদের সেবাকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম এবং মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ব্যবহার বৃদ্ধি করা। তৃতীয়ত, সরকারকে ইসলামিক অর্থনৈতিক মডেলের জন্য একটি অনুকূল আইনি ও নিয়ন্ত্রক কাঠামো তৈরি করতে হবে, যা এই ব্যবস্থাগুলোর সুষ্ঠু পরিচালনা নিশ্চিত করবে।

সুদের পরিবর্তে এমন একটি হালাল ব্যবস্থা সমাজের উন্নতির পথে অন্যতম স্তম্ভ হতে পারে। সুদভিত্তিক অর্থনীতি সমাজে বৈষম্য বৃদ্ধি করে, কারণ এটি পুঁজির কেন্দ্রীভবন ঘটায় এবং দরিদ্রকে আরও দরিদ্র করে তোলে। অন্যদিকে, মুদারাবা ও মুশারাকার মতো অংশীদারিত্বভিত্তিক ব্যবস্থা সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করে এবং নতুন উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করে, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়ক। এই পরিবর্তন সমাজে স্থিতিশীলতা আনবে এবং মানুষকে নৈতিকভাবে সুসংহত করবে।

যদি সুদভিত্তিক অর্থনীতিকে সুদমুক্ত বিকল্প দ্বারা প্রতিস্থাপন না করা হয়, তবে এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব বাংলাদেশের সমাজের জন্য আরও ভয়াবহ হতে পারে।

অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি: সুদ দরিদ্রকে আরও দরিদ্র করে এবং ধনীকে আরও ধনী করে। এটি পুঁজির সঞ্চালন ব্যাহত করে এবং সমাজে এক শ্রেণীর হাতে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়, যা সামাজিক অস্থিরতা বাড়ায়।

সামাজিক অবক্ষয়: সুদের কারণে মানুষ যখন ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে, তখন তাদের মধ্যে হতাশা ও অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি পায়। পারিবারিক কলহ এবং সামাজিক বন্ধনের দুর্বলতা দেখা দিতে পারে, যা সামগ্রিকভাবে সমাজের নৈতিক অবক্ষয় ঘটায়। ইসলামিক মূল্যবোধের অবহেলা: মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হিসেবে সুদের ব্যাপক প্রচলন মানুষের ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি অবহেলা বাড়াতে পারে। এটি একটি জাতির নৈতিক ভিত্তি দুর্বল করে তোলে।

উদ্যোক্তা উন্নয়ন ব্যাহত: উচ্চ সুদের হার ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য বিনিয়োগের পথ রুদ্ধ করে দেয়। নতুন ব্যবসার উদ্যোগ কমে যায়, যা কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বাধা দেয় এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মন্থর করে।

এই সমস্যাগুলো সমাধান না হলে, ভবিষ্যতে বাংলাদেশ একটি অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে ভঙ্গুর রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে, যেখানে দারিদ্র্য ও বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করবে।

বর্তমান এই দুর্বিষহ বাংলাদেশের সংস্কারের দায়িত্ব নিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ডঃ মুহাম্মদ ইউনূস। তাঁর কার্যক্রম বা প্রস্তাবিত পদক্ষেপ এই সমস্যাগুলোর সমাধানে ইতোমধ্যেই আশার আলো দেখাচ্ছে এবং ভবিষ্যতে আরও ব্যাপকভাবে করবে বলে আশা করা যায়। ডঃ ইউনূসের ক্ষুদ্রঋণ মডেল, যদিও সরাসরি ইসলামিক অর্থায়নের ভিত্তিতে নয়, তবুও এর অন্তর্নিহিত দর্শন দরিদ্র মানুষের ক্ষমতায়ন এবং তাদের অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করার দিকেই নিবদ্ধ।

ডঃ ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে জামানতবিহীন ঋণ পৌঁছে দিয়েছেন, যা তাদের ক্ষুদ্র উদ্যোগে বিনিয়োগে সাহায্য করেছে। এই মডেলকে সুদমুক্ত ব্যবস্থার সাথে সমন্বয় করে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করা যেতে পারে। প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ডঃ ইউনূস নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো নিতে পারেন:

ইসলামিক ক্ষুদ্র অর্থায়ন মডেলের প্রসার: গ্রামীণ ব্যাংক বা অনুরূপ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সুদমুক্ত ক্ষুদ্র অর্থায়ন মডেল, যেমন মুদারাবা বা মুশারাকা-ভিত্তিক বিনিয়োগ চালু করা। এর মাধ্যমে দরিদ্র মানুষ ঋণ নয়, বরং ব্যবসার অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে মূলধন পাবে, যা শরীয়াহসম্মত হবে।

প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বৃদ্ধি: ডঃ ইউনূসের নেতৃত্বে ইসলামিক অর্থনীতি ও সুদমুক্ত অর্থায়ন সম্পর্কে ব্যাপক প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা কর্মসূচি চালু করা যেতে পারে। গ্রামীণ ব্যাংকের মতো গ্রামভিত্তিক নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে মানুষকে হালাল উপার্জনের গুরুত্ব এবং বিকল্প ব্যবস্থা সম্পর্কে অবগত করা।

প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন: মোবাইল ব্যাংকিং এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে সুদমুক্ত অর্থায়নকে আরও সহজলভ্য করা। এতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীও সহজেই এই সেবার আওতায় আসতে পারবে।

নীতি সহায়তা: ডঃ ইউনূসের নেতৃত্বে সরকার ইসলামিক অর্থায়ন ব্যবস্থার জন্য অনুকূল নীতি ও নিয়ন্ত্রক কাঠামো তৈরি করতে পারে, যা এই খাতকে শক্তিশালী করবে এবং এর প্রসার ঘটাবে।

ডঃ ইউনূসের এই ধরনের উদ্যোগ মানুষকে সুদ বর্জন করে হালাল উপার্জনের পথে উৎসাহিত করবে এবং সমাজের অর্থনৈতিক বৈষম্য কমাতে সাহায্য করবে। তার প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে বর্তমান সময়ের উদ্যোগ ভবিষ্যতে সমাজের উন্নতি এবং একটি সুদমুক্ত অর্থনীতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

লেখক–

ড. তারনিমা ওয়ারদা আন্দালিব, বর্তমানে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক এবং যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ইমপ্যাক্ট গ্রুপে গ্লোবাল কনসালট্যান্ট ডিরেক্টর হিসেবে কর্মরত আছেন।

দাউদ ইব্রাহিম হাসান, বর্তমানে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন রিসার্চ এসিস্ট্যান্ট এবং সেই সাথে আইডিএলসি ফাইন্যান্স পিএলসি-এর মার্কেটিং বিভাগের একজন সদস্য।


Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *