কুষ্টিয়ায় সার সংকট: ডিলারের গুদামে নেই, খোলা বাজারে চড়া দামে বিক্রি

Spread the love

আক্তারুল ইসলাম, কুষ্টিয়া। 

কুষ্টিয়া জেলার মিরপুর উপজেলাসহ আশপাশের প্রায় সব উপজেলায় চলতি মৌসুমে তীব্র রাসায়নিক সার সংকট দেখা দিয়েছে। সরকারি অনুমোদিত ডিলারের কাছে কৃষকরা নিয়মিত ছুটে গেলেও তারা কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ সার পাচ্ছেন না। অথচ স্থানীয় খোলা বাজারে ও অপ্রাতিষ্ঠানিক বিক্রেতাদের দোকানে সেই একই সার পাওয়া যাচ্ছে প্রতি বস্তা ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা অতিরিক্ত দামে। কৃষকদের অভিযোগ, এটি একটি পরিকল্পিত সংকট, যার সুবিধা নিচ্ছে একশ্রেণির ব্যবসায়ী।

মিরপুর উপজেলার আমলা ইউনিয়নের কৃষক আলাউদ্দিন জানান, তিনি এ মৌসুমে প্রায় ৫ বিঘা জমিতে আমন ধান চাষ করেছেন। সার পাওয়া যাচ্ছে না যদিও পাওয়া যায় চাহিদা অনুপাতে অনেক কম এবং দীর্ঘ দিন ধরে একই অবস্তা। জমিতে প্রয়োগের জন্য কয়েক বস্তা টি এস পি সারের প্রয়োজন হলেও ডিলারের কাছে ১৩৫০ টাকা, অথচ বাজারে গেলে প্রতি বস্তা ১৭০০ টাকা থেকে ১৭৫০ টাকা ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা অতিরিক্ত দিয়ে সহজেই পাওয়া যাচ্ছে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “ডিলারের কাছে গেলে বলে— সরবরাহ কম থাকায় কৃষকের চাহিদা অনুপতে দিতে পারছিনা। খোলা বাজারে সারের কোন সংকট নেই।

একই অভিজ্ঞতার কথা জানান কুষ্টিয়া জেলার সবকটি উপেজলার গ্রামের কৃষকরা বলেন, “সরকার নির্ধারিত মূল্যে সার কেনা আমাদের অধিকার। কিন্তু ডিলাররা আমাদের বঞ্চিত করছে। ফলে প্রান্তিক কৃষকরা বাধ্য হয়ে দালাল বা খোলা বাজারের চড়া দামে সার কিনতে বাধ্য হচ্ছেন।”

কুষ্টিয়া সদর, খোকসা, দৌলতপুর, ভেড়ামারা, কুমারখালী এবং মিরপুর—সব উপজেলাতেই একই অভিযোগ পাওয়া গেছে। কৃষকদের মতে, সরকারি ডিলারদের অনেকেই সার গোপনে বাজারে ছেড়ে দিচ্ছে, যাতে বাড়তি দামে বিক্রি করে বেশি লাভ করা যায়। ফলে কৃষকদের হাতে সরকারি নির্ধারিত দামে সার পৌঁছাচ্ছে না।

খোলা বাজারে সার ব্যবসায়ীরা প্রকাশ্যেই চড়া দামে সার বিক্রি করছেন। কুষ্টিয়ার বড় বাজারগুলোতে খোলা দোকানেই এক বস্তা ইউরিয়া ১৭০০ থেকে ১৭৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যেখানে সরকারি নির্ধারিত দাম ১৪০০ টাকার নিচে। চাহিদা বেশি হওয়ায় কৃষকরা বাধ্য হয়ে এই বাড়তি দাম দিয়ে কিনছেন।

মিরপুর বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, প্রায় প্রতিটি দোকানেই ইউরিয়া ও ডিএপি সারের বস্তা স্তুপ করে রাখা আছে। বিক্রেতাদের কাছে জানতে চাইলে তারা খোলাখুলিভাবেই বলেন, ডিলারদের কাছ থেকে সরবরাহ পাওয়া যায়। তবে এভাবে চড়া দামে বিক্রি করা নিয়ে তারা কোনো জবাব দিতে রাজি হননি।

কৃষক সমাজের প্রশ্ন, প্রশাসন এসব বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না কেন? জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কৃষি অফিস, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদারকি কার্যত চোখে পড়ছে না।

মিরপুর উপজেলা কৃষি অফিসের এক কর্মকর্তা স্বীকার করেন, কৃষকদের কাছ থেকে নিয়মিত অভিযোগ আসছে। তবে তিনি জানান, বরাদ্দকৃত সার যথাযথভাবে ডিলারদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। বাজারে অতিরিক্ত দামে সার বিক্রির ব্যাপারে তিনি সরাসরি মন্তব্য না করলেও বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে বলে আশ্বাস দেন।

অন্যদিকে জেলা প্রশাসনের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, সার বিক্রিতে কোনো অনিয়ম হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে এখনো পর্যন্ত কোনো ডিলারের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ পাওয়া যায়নি।

বাংলাদেশের কৃষি নির্ভর অর্থনীতিতে সার অন্যতম অপরিহার্য উপকরণ। ধান, সবজি, ডাল, গমসহ প্রায় সব ফসলেই রাসায়নিক সারের ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই। কুষ্টিয়া অঞ্চলের কৃষকরা মূলত ধান, পাট, ভুট্টা এবং সবজি উৎপাদন করে থাকেন। এসব ফসলের মৌসুমে সারের সংকট দেখা দিলে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।

কৃষি বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যদি দ্রুত এ সংকট দূর না করা হয়, তবে আগামী মৌসুমে উৎপাদন কমে যাবে। এতে বাজারে ধান-চালের দাম বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি কৃষকের উৎপাদন খরচও বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের এক অধ্যাপক বলেন, “কৃষক যদি নির্ধারিত দামে সার না পায়, তবে তারা উৎপাদন খরচ সামলাতে পারবে না। এতে একদিকে কৃষি উৎপাদন কমবে, অন্যদিকে কৃষকের আয়ও হ্রাস পাবে। ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।”

বিশেষজ্ঞদের মতে, সারের বাজারে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হলে কিছু কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
জেলা প্রশাসন ও কৃষি অফিসের নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে বাজারে নজরদারি বাড়াতে হবে।
সার বরাদ্দ থেকে কৃষকের হাতে পৌঁছানো পর্যন্ত ডিজিটাল ট্র্যাকিং সিস্টেম চালু করতে হবে।
কৃষকদের জন্য বিশেষ কার্ড বা ডিজিটাল আইডি চালু করা যেতে পারে, যার মাধ্যমে তারা নির্ধারিত মূল্যে সার সংগ্রহ করতে পারবেন।অনিয়মে জড়িত ডিলারদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ও আইনগত কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

কুষ্টিয়ার কৃষকরা এখনো সরকারের প্রতি আশাবাদী। তারা চান, সরকার দ্রুত হস্তক্ষেপ করে সার বাজারকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনুক। তাদের বিশ্বাস, যদি সঠিক সময়ে সঠিক দামে সার সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়, তবে এ অঞ্চলের কৃষি উৎপাদনে কোনো সমস্যা হবে না।

মিরপুরের প্রবীণ কৃষক তাজমত আলী বলেন, “আমরা জীবিকা নির্বাহ করি কৃষির উপর নির্ভর করে। যদি জমিতে সার না থাকে, ফসল কেমন হবে? সরকার যদি দ্রুত ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে আমাদের বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।”

কুষ্টিয়ার প্রায় সব উপজেলায় সার সংকট আজ একটি বড় সমস্যায় রূপ নিয়েছে। সরকারি ডিলারের কাছে না পাওয়া গেলেও খোলা বাজারে অতিরিক্ত দামে সার বিক্রি—এ এক অস্বাভাবিক চিত্র। কৃষক সমাজ মনে করছে, এটি একটি পরিকল্পিত সংকট। প্রশাসন যদি দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা না নেয়, তবে শুধু কৃষক নয়, দেশের সামগ্রিক কৃষি উৎপাদন ও খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে।

 


Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *