
আক্তারুল ইসলাম, কুষ্টিয়া।
বাংলা সংস্কৃতির অন্যতম মহান গীতিকবি ও দার্শনিক ফকির লালন শাহের আখড়াবাড়ি ঘিরে নিরাপত্তা জোরদার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার ঐতিহাসিক ছেঁউড়িয়ায় অবস্থিত লালন শাহের আখড়াবাড়িতে শনিবার সকাল থেকে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। কুষ্টিয়া জেলা পুলিশ ও কুমারখালী থানা পুলিশের একটি যৌথ দল সেখানে ২৪ ঘণ্টা নিরাপত্তা দায়িত্ব পালন করছে।
পুলিশ প্রশাসন বলছে, এটি একটি নিয়মিত সতর্কতামূলক পদক্ষেপ। কোনো ধরনের হামলার আশঙ্কা বা হুমকি নেই। তবে লালন শাহের আসন্ন তিরোধান দিবসকে কেন্দ্র করে দর্শনার্থীর চাপ বাড়বে, তাই নিরাপত্তার ঘেরাটোপ আরও শক্ত করা হয়েছে।
কুষ্টিয়া জেলা পুলিশের মুখপাত্র ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফয়সাল মাহমুদ জনতারকথাকে বলেন, সতর্কতার অংশ হিসেবেই আখড়াবাড়িতে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত পুলিশ মোতায়েন থাকবে। এখানে পুলিশ সদস্যরা সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করবেন। তবে কোনো ধরনের আশঙ্কাজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।
আখড়াবাড়ি সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শনিবার সকাল থেকে আখড়াবাড়ির মূল ফটক ও ভেতরে পুলিশের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। স্থানীয় বাসিন্দা এস এম রাশেদ বলেন, সকাল থেকে কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে আখড়াবাড়ির ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। ভেতরে ও আশপাশেও টহল দিচ্ছেন তারা।
আগামী ১ কার্তিক (১৭ অক্টোবর) ফকির লালন শাহের ১৩৪তম তিরোধান দিবস। প্রতিবছরের মতো এবারও দিনটি ঘিরে লাখো মানুষ ছুটে আসবেন কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায়। তবে এবারের আয়োজনকে কেন্দ্র করে রয়েছে বাড়তি তাৎপর্য। প্রথমবারের মতো সরকার লালনের তিরোধান দিবসকে ‘ক’ শ্রেণিভুক্ত হিসেবে জাতীয়ভাবে পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এ বছর থেকে লালন শাহের তিরোধান দিবস জাতীয়ভাবে পালিত হবে। এ উপলক্ষে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে আয়োজন করা হবে তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠান। থাকবে আলোচনা সভা, লালনসঙ্গীত পরিবেশনা, গবেষণা প্রবন্ধ পাঠ, প্রদর্শনী ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
ফকির লালন শাহ (১৭৭৪–১৮৯০) ছিলেন মানবতাবাদী দর্শনের অন্যতম প্রধান গায়ক, কবি ও সাধক। তাঁর গান, দর্শন ও আখড়াবাড়িকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে সমৃদ্ধ এক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’—এই দর্শন দিয়ে তিনি ভেদাভেদহীন সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন।
আজও লালনের গান ও দর্শন বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী গবেষণা ও অনুপ্রেরণার উৎস। প্রতিবছর তিরোধান দিবসে দেশ-বিদেশ থেকে হাজার হাজার দর্শক, ভক্ত ও গবেষক ছুটে আসেন ছেঁউড়িয়ায়।
সংস্কৃতি বিষয়ক গবেষক ড. নাজমুল হক বলেন, লালন শুধু একজন কবি বা সাধক নন, তিনি ছিলেন সামাজিক সংস্কারক। তাঁর গান ও দর্শন গ্রামীণ সমাজে মানবিকতার আলো ছড়িয়েছে। জাতীয়ভাবে তাঁর দিবস পালনের সিদ্ধান্ত সাংস্কৃতিক জাগরণে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।
প্রতিবছর তিরোধান দিবসকে কেন্দ্র করে কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়া পরিণত হয় মিলনমেলায়। আখড়াবাড়ি প্রাঙ্গণে বসে লোকসংগীতের আসর, চলে আধ্যাত্মিক আলোচনা। ভক্তরা সারারাত লালনগীতির সুরে মাতোয়ারা থাকেন। এবারও লাখো মানুষের সমাগম ঘটবে বলে আশা করছে আয়োজক কর্তৃপক্ষ।
কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক আরও বলেন, আসন্ন আয়োজনে ভক্ত, গবেষক ও পর্যটকের চাপ বাড়বে। তাই নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। একই সঙ্গে স্থানীয় পর্যায়ে আবাসন, যোগাযোগ ও জনসেবার ব্যবস্থা নিয়েও কাজ চলছে।
কুমারখালী উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানান, তিরোধান দিবসের অনুষ্ঠান ঘিরে জেলা প্রশাসন, লালন একাডেমি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ে বিশেষ কর্মপরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে।
জেলা পুলিশ সূত্র বলছে, শুধু আখড়াবাড়িই নয়, ছেঁউড়িয়া এলাকায় প্রবেশপথ, কুষ্টিয়া-কুমারখালী সড়ক এবং নদীপথেও বাড়ানো হবে টহল। দর্শনার্থীদের নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত করতে ট্রাফিক ব্যবস্থাও জোরদার করা হবে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রত্যাশা, জাতীয়ভাবে দিবস পালনের মাধ্যমে লালনের দর্শন ও গানের প্রচার আরও ব্যাপক হবে। পাশাপাশি কুষ্টিয়ার পর্যটন খাতও নতুন মাত্রা পাবে।
স্থানীয় সাংস্কৃতিক কর্মী হায়দার আলী বলেন, প্রতিবছর আমরা লালনের গানে-আসরে মেতে উঠি। এবার সরকারিভাবে দিবস পালনের ঘোষণা আমাদের গর্বিত করেছে। তবে নিরাপত্তার পাশাপাশি ভক্তদের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতি ও মানবতাবাদী দর্শনের প্রতীক ফকির লালন শাহ। তাঁর স্মৃতি জাগ্রত রাখতে প্রতিবছর আখড়াবাড়িতে যে মিলনমেলার আয়োজন হয়, তা জাতীয় সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। এ বছর সরকারের উদ্যোগে জাতীয়ভাবে দিবস পালনের সিদ্ধান্ত লালনচর্চাকে আরও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেবে বলে মনে করছেন গবেষক ও সংস্কৃতিকর্মীরা।
আর দর্শনার্থীদের নিরাপদ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাড়তি প্রস্তুতি কুষ্টিয়াকে ইতিমধ্যেই সরব করে তুলেছে। এখন অপেক্ষা লাখো ভক্তের পদচারণায় ছেঁউড়িয়ার প্রাঙ্গণ নতুন করে মুখর হয়ে ওঠার।