আইয়ুব আলী এক সাধারণ মানুষের অসাধারণ জীবনসংগ্রাম

Spread the love

আক্তারুল ইসলাম, কুষ্টিয়া।

জাতীয় জীবনে আমরা প্রায়ই বীর, রাজনীতিক, নায়ক কিংবা সমাজের বিত্তশালী মানুষদের আলোচনায় আনি। অথচ এই মাটির দেশে এমন কিছু মানুষ আছেন, যাদের জীবন হয়তো বহির্বিশ্বে অচেনা, কিন্তু তাদের ত্যাগ, সততা ও দায়িত্ববোধে লুকিয়ে আছে সমাজ পরিবর্তনের শক্তি। কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার আমলা বাজারে প্রতিদিন দাঁড়িয়ে থাকেন এমনই এক মানুষ—আইয়ুব আলী। হাতে বাঁশি, পরনে খাকি প্যান্ট, পাশে লাঠি—এ যেন পুরো বাজারের ট্রাফিক শৃঙ্খলার প্রতীক।

পেশাগতভাবে তিনি কখনও ট্রাফিক পুলিশ ছিলেন না, কোনো সরকারি পদেও ছিলেন না। তবু দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে স্বেচ্ছাশ্রমে বাজারের যানজট নিয়ন্ত্রণ করছেন। আগে তিনি ছিলেন ভ্যানচালক, তারও আগে ছিলেন কেবল এক দরিদ্র পরিবারের সন্তান। আজকের গল্প সেই সাধারণ অথচ অসাধারণ মানুষটির জীবনকথা।

শেকড় থেকে কুষ্টিয়ার আমলায়, আইয়ুব আলীর শেকড় মিরপুর উপজেলার ইশিলমারী গ্রামে। ছোটবেলা থেকেই তিনি জানতেন—দারিদ্র্য পিছু ছাড়বে না। সংসারের দায়ভার কাঁধে নিতে হবে অল্প বয়সেই। ১৯৭৫ সালে তিনি বিয়ে করেন শান্তি নামের এক বিনয়ী নারীকে। শান্তি ছিলেন আমলা গ্রামের মেয়ে। স্ত্রীকে ঘরে তুলে তিনি স্থায়ীভাবে চলে আসেন আমলায়।

কেন নিজের গ্রাম ছেড়ে এলেন? এমন প্রশ্নের জবাবে আইয়ুব আলী হেসে বলেন— শান্তিকে ঘরে তোলার পরই শান্তি পেয়েছি। আমলা শিক্ষিত মানুষের জায়গা। এখানে আসার পর সবাই আমাকে ভালো বলেছে। তাই আমলাকে আমি প্রাণ থেকে ভালোবাসি।

এই ভালোবাসা পরবর্তীতে রূপ নিয়েছে দায়িত্বে, আর দায়িত্বের মধ্য দিয়েই গড়ে উঠেছে তাঁর জীবনের দর্শন।

প্রথম অধ্যায়: ভ্যানচালকের সংগ্রাম, আমলায় আসার পর প্রথম জীবিকার পথ হিসেবে বেছে নেন ভ্যান চালানো। সেই সময় প্রায় বিশ বছর টানা ভ্যান চালিয়েই তিনি পরিবার চালিয়েছেন।

আমলা সদরপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক আনোয়ারুল হুদা স্কুল ফান্ড থেকে দুটি ভ্যান কিনেছিলেন। একটি ভ্যান দেওয়া হয় আইয়ুব আলীর হাতে। চুক্তি ছিল—প্রতিদিন ৭–৮ টাকা করে স্কুলে জমা দিতে হবে।

আইয়ুব আলী সেই দায়িত্ব সততার সঙ্গে পালন করেছেন। প্রতিদিনের আয় থেকে সামান্য ভাড়া কেটে স্কুল ফান্ডে টাকা জমা দেওয়া ছিল তাঁর নিয়মিত কাজ।

তখন আমলা-মিরপুর ভাড়া ছিল মাত্র দেড় টাকা। ছয়জন যাত্রী নিয়ে একবার গেলে পাওয়া যেত নয় টাকা। দিনে কয়েকবার এভাবে চলাফেরা করেই সংসার চলত।

স্থানীয় শিক্ষক আবদুল কাদের স্মৃতিচারণা করে বলেন, আমি তখন স্কুলের ছাত্র ছিলাম। দেখতাম, আইয়ুব আলী ভ্যান চালিয়ে প্রতিদিন শেষে স্যারদের কাছে টাকা জমা দিতেন। তাঁর মতো সৎ ভ্যানচালক খুব কমই দেখেছি।

ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে স্বেচ্ছাশ্রম, প্রায় বিশ বছর আগে আমলা বাজারে ঘটে একটি দুর্ঘটনা। তখন হঠাৎ করেই আইয়ুব আলী তাঁর ভ্যানে তালা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে যান চার রাস্তার মোড়ে। উদ্দেশ্য—রাস্তার যানজট নিয়ন্ত্রণ করা।

প্রথমে বিষয়টি অনেকের কাছে অদ্ভুত মনে হয়েছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে সবাই বুঝলেন, তাঁর কাজটা আসলে প্রয়োজনীয়। ইউনিয়ন চেয়ারম্যান, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এমনকি বাস কন্ট্রাক্টররা তাঁকে উৎসাহ দেন।

আইয়ুব আলী স্মৃতিচারণ করে বলেন— গফুর ভাই চেয়ারম্যান ছিলেন, সদরপুরের চেয়ারম্যান হক ভাই ছিলেন, তাঁদের উৎসাহে এই কাজ শুরু করি। তাঁরা বাস কন্ট্রাক্টরদের বলেছিলেন, তোমরা আইয়ুব আলীকে দু’এক টাকা দিয়ে যাবে, তোমাদেরই উপকার হবে।

এরপর থেকে প্রতিদিনই তিনি খাকি প্যান্ট পরে বাঁশি বাজিয়ে দাঁড়িয়ে যান মোড়ে। বড়-ছোট গাড়ি নিয়ন্ত্রণ, যাত্রী ওঠানামায় সহায়তা, দুর্ঘটনা এড়ানো—সবই তিনি করেন নিঃস্বার্থভাবে।

বর্তমান আয়ের বাস্তবতা, এখন প্রতিটি গাড়ি আপ-ডাউনে তাঁকে ৪/৫ টাকা করে দেয়। দিনে গড়ে আয় হয় ২২০–২৩০ টাকা। তবে এটি সংগ্রহ করে নিতে হয়।

বৃষ্টির দিনে আয় কমে যায়, কারণ বাসের জানালা বন্ধ থাকলে টাকা দেওয়া মুশকিল হয়। আবার ঈদ বা বিশেষ দিনে কেউ তাঁকে ৫০, ১০০ কিংবা এমনকি পানির বোতল উপহার দেন। তাঁর মতে, মানুষের ভালোবাসাই আসল উপার্জন।

স্থানীয় ব্যবসায়ী সুজন আহাম্ম্দে বলেন,আমলা বাজারে যানজট থাকত, কিন্তু আইয়ুব আলী আসার পর অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। তিনি না থাকলে এখানে ট্রাফিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ত।

সমাজের প্রতি ভালোবাসা আজ প্রায় ষাটোর্ধ্ব আইয়ুব আলী প্রতিদিন দাঁড়িয়ে থাকেন একই জায়গায়। দীর্ঘ দিনের পরিশ্রমে শরীর ক্লান্ত হলেও মন ভাঙে না।

তিনি বলেন— মানুষ বিপদে পড়লে কষ্ট লাগে। গাড়ি চলাচল শৃঙ্খলিত থাকলে দুর্ঘটনা কমে। আমি যদি একটু দাঁড়িয়ে মানুষকে সাহায্য করতে পারি, সেটাই আমার শান্তি।

এই দায়বদ্ধতাই তাঁকে অন্যদের থেকে আলাদা করেছে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আইয়ুব আলীর গল্প বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ— অদৃশ্য শ্রম, তিনি কোনো সরকারি কর্মচারী নন, কিন্তু দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে বিনা বেতনে কাজ করছেন। গ্রামীণ ট্রাফিক বাস্তবতা, শহরে ট্রাফিক পুলিশ থাকলেও উপজেলা পর্যায়ের বাজারগুলোতে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ নেই। সেখানে আইয়ুব আলীর মতো মানুষ কার্যত জননিরাপত্তা নিশ্চিত করছেন। মানুষের আস্থা: সততা ও মানবিকতার মাধ্যমে তিনি বাজারের মানুষের কাছে আস্থা অর্জন করেছেন। সমাজের শিক্ষা, তাঁর জীবন প্রমাণ করে, উন্নয়ন কেবল সরকারি প্রকল্পে নয়, মানুষের মনোজাগতিক দায়িত্ববোধেও নিহিত।

শিক্ষা ও অনুপ্রেরণা, আইয়ুব আলীর জীবন আমাদের শিখিয়ে দেয়— দায়িত্ববোধ থাকলে যে কেউ সমাজে অবদান রাখতে পারে। অর্থ নয়, বরং সততা ও সেবাই একজন মানুষকে সম্মানিত করে। নীরব নায়কেরাও সমাজে সমান গুরুত্বপূর্ণ।

আমলা সরকারি ডিগ্রী কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ওয়াশিম আকরাম মন্তব্য করেন—
আইয়ুব আলীর মতো মানুষরা বাংলাদেশের অদৃশ্য নায়ক। তাঁদের অবদান রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত।

এক সাধারণ মানুষের অসাধারণতা, আইয়ুব আলীর জীবনের কাহিনি আসলে আমাদের সমাজের আয়না। তিনি না হয় ভ্যানচালক ছিলেন, না হয় কোনো পদবী পাননি—কিন্তু তিনি মানুষের ভালোবাসা অর্জন করেছেন। আমলা বাজারের মানুষ তাঁকে ‘ট্রাফিক পুলিশ’ বলেই চেনে।

আমাদের জাতীয় জীবনে উন্নয়ন বলতে শুধু সেতু, ফ্লাইওভার বা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নয়; বরং উন্নয়ন মানে হলো আইয়ুব আলীর মতো নিঃস্বার্থ মানুষদের কদর করা। রাষ্ট্র যদি তাঁদের স্বীকৃতি দেয়, সমাজ যদি তাঁদের সম্মান করে, তবেই প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশ এগোবে।

 

 


Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *