
আক্তারুল ইসলাম, মিরপুর, কুষ্টিয়া।
কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলায় দফায় দফায় সবজির দাম বেড়ে সাধারণ ক্রেতারা চরম বিপাকে পড়েছেন। পৌর কাঁচাবাজার থেকে শুরু করে উপজেলার বিভিন্ন স্থানীয় বাজারেও একই চিত্র—প্রায় সব ধরনের সবজির দাম ৬০ টাকার ওপরে। নিম্ন আয়ের মানুষ বাজারে গিয়ে হতাশ হচ্ছেন, বাড়তি দামে ক্ষুব্ধ ক্রেতারা বলছেন—“মনিটরিং না থাকায় বাজারে নৈরাজ্য চলছে।” ব্যবসায়ীরা অবশ্য দায় দিচ্ছেন সরবরাহ কমে যাওয়াকে।
শুক্রবার (২৮ নভেম্বর) সকালে মিরপুর পৌর কাঁচাবাজারে সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, প্রতিটি দোকান ও ফেরিওয়ালার কাছে সবজির দাম সাম্প্রতিক সময়ের তুলনায় দ্বিগুণ থেকে প্রায় দেড়গুণ বেড়ে গেছে। বাজারে গিয়েই অসহায় বোধ করছেন দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো। কেউ কেউ প্রয়োজনের অর্ধেক কিনেই ফিরে যাচ্ছেন, আবার কেউ বাজার ঘুরে শেষ পর্যন্ত কোনো বিকল্প খুঁজে পাচ্ছেন না।
কম দামের সবজি হিসেবে পরিচিত বেগুন দুই সপ্তাহ আগেও কেজিতে ৫০ টাকা বিক্রি হলেও বর্তমানে তার দাম ১০০ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। কাঁচা মরিচের দাম আরও ভয়াবহ—৮০ টাকা থেকে লাফিয়ে এখন ১৬০ থেকে ২০০ টাকা কেজি। স্থানীয় বাজারে এমন দাম দীর্ঘদিন দেখা যায়নি বলে জানান ক্রেতারা।
এ ছাড়াও পটল ৪০ টাকা থেকে বেড়ে ৬০ টাকা, চালকুমড়া ২০ টাকা থেকে ৪০ টাকা, ঝিঙা ৪০ থেকে ৬০ টাকা, লাউ ৩০ টাকা থেকে বেড়ে ৫০ টাকা এবং ঢেঁড়স ৫০ টাকা থেকে বেড়ে ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। শুধু এসব সবজি নয়, প্রতিদিনের অপরিহার্য পেঁয়াজ, রসুন, আদা, মিষ্টিকুমড়া, পেঁপে ও কাঁচা কলার দামও বেড়েছে ১০ থেকে ২৫ টাকার বেশি।
বাজারে ক্রেতা আশরাফুল হক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “৫০ টাকার বেগুন ১০০ টাকা! সবজির এমন দাম কখনো দেখি নাই। গরিব মানুষের জন্য বাজার করা অসম্ভব হয়ে গেছে। মনিটরিং না থাকায় ব্যবসায়ীরা ইচ্ছেমতো দাম বাড়াচ্ছে।” তিনি আরও বলেন, “প্রতিদিনই বাজারে নতুন সংকট। অথচ কেউ দেখার নেই।”
স্থানীয় গৃহিণী জাহানারা খাতুন জানান, পরিবারের খরচ সামলাতে এখন শুধু সবজি কিনতেই আগের তুলনায় দ্বিগুণ টাকা লাগে। “একটা সময় ৩০০ টাকায় সপ্তাহের সবজি হয়ে যেত। এখন ৩০০ টাকা দিয়ে দুই দিনের সবজি হয় না,”—বলেন তিনি।
অন্যদিকে অভিযোগ অস্বীকার করে ব্যবসায়ীরা বলছেন, তারা বেশি দামে এনে বেশি দামে বিক্রি করতে বাধ্য। মিরপুরের আমলা বাজারের এক খুচরা ব্যবসায়ী জয়নাল বলেন, “চাহিদার তুলনায় বাজারে সরবরাহ কমে গেছে। আমরা পাইকারি বাজার থেকে বেশি দামে কিনি, তাই বেশি দামে বিক্রি করি। আমাদের লাভ তো খুব সীমিত। দাম বাড়ানো বা কমানোর ক্ষমতা আমাদের নেই।”
তিনি আরও জানান, কয়েকদিন ধরে পাইকারি বাজারে অনেক সবজির সরবরাহ কম। মাঠে কিছু সবজির উৎপাদন কম হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
তবে ক্রেতারা বলছেন, পাইকারি বাজারে দাম কিছুটা বাড়লেও খুচরা বাজারে তার চেয়ে বেশি বাড়ানো হচ্ছে। “বাজারে কারসাজি হচ্ছে। ১০ টাকা বাড়লে খুচরায় ২০–২৫ টাকা বাড়ানো হচ্ছে,”—বললেন এক ভোক্তা।
অস্বাভাবিক দামের বিষয়ে জানতে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর কুষ্টিয়ার সহকারী পরিচালক মাসুম আলীকে ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। একইভাবে বাজার পরিস্থিতি নিয়ে জানতে মিরপুর উপজেলা কৃষি অফিসারের মুঠোফোনে কল করা হলে সাড়া পাওয়া যায়নি।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের কুষ্টিয়া জেলা কার্যালয়ের সিনিয়র কৃষি বিপণন কর্মকর্তা আব্দুল মান্নান হাওলাদার বলেন, বাজারে কেউ অস্বাভাবিক হারে দাম বাড়ালে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তিনি জানান, বিষয়টি নজরে এসেছে। প্রয়োজনে বাজার মনিটরিং জোরদার করা হবে এবং অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হবে। “ভোক্তাদের অভিযোগ আমরা গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করি। বাজার নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনে উপজেলায় যৌথ অভিযান চালানো হবে,”—বলেন তিনি।
সবজির দাম বৃদ্ধির সবচেয়ে বড় ধাক্কা লেগেছে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে। যাদের আয় স্থির, কিন্তু বাজারের দাম প্রতিনিয়ত বাড়ছে। অনেকেই এখন বিকল্প খুঁজছেন—কম দামের সবজি কিনছেন, আগের মতো বৈচিত্র্য আর থাকছে না তাদের খাবারের টেবিলে।
স্থানীয় এক শিক্ষক নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বলেন, “আগে সপ্তাহে তিন–চার রকম সবজি কিনতাম। এখন দাম দেখে দুই রকমেই সীমাবদ্ধ থাকতে হয়। মাংস তো অনেক আগেই তালিকা থেকে বাদ গেছে।”
সবজি বিক্রেতা, ক্রেতা, স্থানীয় দোকানি—সব মহল থেকেই বাজার মনিটরিংয়ের দাবি উঠেছে। ক্রেতারা বলছেন, শুধু অভিযান নয়, নিয়মিত তদারকি প্রয়োজন।
এক প্রবীণ ক্রেতা নবীরুল শাহা বলেন, “বছরের পর বছর একই কথা শুনি—সরবরাহ কম, দাম বেড়েছে। কিন্তু কেউ যাচাই করে না। সরকার যদি নিয়মিত বাজার মনিটরিং করত, এত বেশি দাম বাড়তে পারত না।”
মিরপুরে দিন দিন অসহনীয় হয়ে ওঠা সবজির দাম নিয়ে সাধারণ মানুষের উদ্বেগ বাড়ছেই। সংশ্লিষ্ট বিভাগের দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে আগামী সপ্তাহগুলোতে দাম আরও বাড়তে পারে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।