সিন্ডিকেটের থাবায় মুখ থুবড়ে পড়ল চামড়ার বাজার

Spread the love

রাজশাহী  প্রতিনিধি।

দেশে বেশ কয়েক বছর ধরে সক্রিয় রয়েছে চামড়া সিন্ডিকেট। বিভিন্ন অজুহাতে প্রতিবছর কোরবানির মৌসুমে কমিয়ে দেওয়া হয় কাঁচা চামড়ার দাম। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সরকার থেকে নির্ধারিত দাম বেঁধে দেওয়া হলেও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়া বিক্রি করে লোকসানে পড়েছেন। শক্তিশালী সিন্ডিকেটের কারণে তারা সরকারের নির্দেশনাকেও অগ্রাহ্য করেছে। ফলে নির্ধারিত দামে চামড়া বিক্রি করতে না পেরে লোকসানের বোঝা বহন করতে হয়েছে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের।

প্রতিবারের মতো এবারও রাজশাহীতে সক্রিয় ছিল চামড়া সিন্ডিকেট। তারা নানা অজুহাতে চামড়ার দাম কমিয়েছে। এবারের অজুহাত ছিল, কোরবানির গরুতে ‘ল্যাম্পি স্কিন’ বা অ্যানথ্রাক্স রয়েছে। অনেকে আবার চামড়ার মান খারাপ বলেও অভিযোগ তুলেছেন।

তবে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, অসুস্থ কোরবানির পশু বিক্রির সুযোগ নেই। হাট বা খামারে এমন পশু বিক্রি হয়নি। আর অসুস্থ পশু কোরবানি করাও ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে বৈধ নয়।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. রুহুল আমিন বলেন, কোরবানির জন্য সুস্থ ও নিখুঁত পশু আবশ্যক। পশুর দৃষ্টিশক্তি, হাঁটা-চলা এবং আচরণ পরীক্ষা করতে হয়। সুস্থ পশু কোরবানি হলে সেটি কবুল হয়। অসুস্থ পশু কোরবানি দেওয়া শরিয়তসম্মত নয়।

এ বছর সরকার গরুর কাঁচা চামড়ার দাম প্রতি বর্গফুটে ৫ থেকে ১০ টাকা বাড়িয়েছে। কিন্তু মাঠপর্যায়ে এর কোনো প্রভাব পড়েনি। বরং সিন্ডিকেট তাদের ইচ্ছেমতো দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে।

সরকার প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম ৬০ থেকে ৬৫ টাকা নির্ধারণ করলেও বাস্তবে চামড়া বিক্রি হয়েছে অর্ধেক দামে। এতে রাজশাহী জেলা ও মহানগরের প্রায় তিন হাজার মৌসুমি ব্যবসায়ী লোকসানের মুখে পড়েছেন।

গেল ২৬ মে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কোরবানির পশুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেয়। ঢাকার বাইরে প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয় ৫৫ থেকে ৬০ টাকা, যা গত বছর ছিল ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। সর্বনিম্ন কাঁচা চামড়ার দাম ধরা হয় ১ হাজার ১৫০ টাকা। খাসির লবণযুক্ত চামড়া ২২ থেকে ২৭ টাকা এবং বকরির চামড়া ২০ থেকে ২২ টাকা নির্ধারণ করা হলেও বাস্তবে ছাগল বা ভেড়ার চামড়ার দাম মেলেনি। ফলে অনেকেই এই চামড়া নদী ও পুকুরে ফেলে দিয়েছেন।

মৌসুমি ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত দুই বছরের তুলনায় এবার বাজার সবচেয়ে খারাপ গেছে। চামড়া কেনা হয়েছে ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকায়, কিন্তু বিক্রির সময় ৫০০ টাকাও ওঠেনি। লবণ, শ্রমিক ও পরিবহনসহ অন্যান্য খরচ বাদ দিলে আরও বড় লোকসানে পড়তে হয়েছে। শুধু দাম নির্ধারণ করলেই হবে না, বরং তা বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। বাজার মনিটরিং, মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব হ্রাস এবং মৌসুমি ব্যবসায়ীদের জন্য প্রণোদনা ও সহায়তার ব্যবস্থা করাও জরুরি। না হলে প্রতি বছরই চামড়ার বাজার এইভাবে ভেঙে পড়বে।

এ বছর রাজশাহী জেলায় কোরবানি হয়েছে ৩ লাখ ৪১ হাজার ৪৪৬টি পশু। রাজশাহী বিভাগের আট জেলার মাদরাসা, এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিংগুলোতে দুই লাখ ৮৭ হাজার ৫২৪টি গরু, মহিষ ও ছাগলের চামড়া লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এর মধ্যে গরু ও মহিষের চামড়া ১ লাখ ১০ হাজার ৯০৫টি এবং ছাগলের চামড়া ১ লাখ ৭৬ হাজার ৬১৯টি। রাজশাহীতে ৬৭ হাজার ২৪৭টি, নাটোরে ৫৩ হাজার ৫১৩টি, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১৬ হাজার ৭৩৮টি, বগুড়ায় ২৩ হাজার ৪৩৬টি, পাবনায় ১৫ হাজার ৯৮৪টি, সিরাজগঞ্জে ২৩ হাজার ২২২টি, নওগাঁয় ২১ হাজার ২৭৩টি এবং জয়পুরহাটে ৬৬ হাজার ১১১টি চামড়া সংরক্ষণ করা হয়েছে।

চামড়ার দাম ও গরিবদের হক আদায়ের জন্য এ বছর সরকার মসজিদ, মাদরাসা ও এতিমখানাগুলোতে বিনামূল্যে ৩০ হাজার মেট্রিকটন লবণ সরবরাহ করেছে। এতে স্থানীয়ভাবে ২–৩ মাস পর্যন্ত চামড়া সংরক্ষণ করা সম্ভব হচ্ছে।

রাজশাহী চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির নিবন্ধিত সদস্য ৯৭ জন। তাদের অধীনে জেলায় প্রায় ৩ হাজার মৌসুমি ব্যবসায়ী বিভিন্ন উপজেলা ও মহানগর এলাকায় ঘুরে ঘুরে চামড়া সংগ্রহ করেছেন। তবে এবার অধিকাংশ চামড়াই গেছে মাদরাসা ও এতিমখানাগুলোতে।

সিন্ডিকেটের কারণে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ক্ষতির মুখে পড়েছেন। কেউ কেউ তাদের পুঁজি পর্যন্ত হারিয়েছেন। পবার মৌসুমি ব্যবসায়ী মুস্তাক আহমেদ বলেন, সরকারের নির্ধারিত উচ্চমূল্যের আশায় ৩০০ পিস চামড়া কিনেছি, যার অধিকাংশই ছোট গরুর। প্রতিটি ৭০০ থেকে ৯০০ টাকায় কিনেছি। ঈদের দিন সারা দিন ঘুরে ঘুরে চামড়া সংগ্রহ করে বিকেলে বাজারে তুললেও প্রথম ৪-৫ ঘণ্টা কেউ দামই বলেনি। পরে গড়ে ৩৩০ টাকা দরে বিক্রি করেছি। এতে ৬০ শতাংশের বেশি ক্ষতি হয়েছে। সিন্ডিকেট না ভাঙলে চামড়ার বাজারে কখনোই স্থিতি আসবে না।

মোহনপুরের চামড়া ব্যবসায়ী আবদুর রউফ বলেন, আমি দেড় হাজার চামড়া কিনেছি, যার প্রতিটি ৫০০ থেকে ৭০০ টাকায় সংগ্রহ করা। চামড়াগুলো লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করেছি। কিছু চামড়ায় রোগ থাকতে পারে, তবে সেটা যাচাই করার দরকার আছে। ট্যানারি মালিকরা কীভাবে মূল্যায়ন করেন সেটাও গুরুত্বপূর্ণ।

রাজশাহী চামড়া ব্যবসায়ী গ্রুপের সভাপতি আসাদুজ্জামান মাসুদ বলেন, আমি দেখাতে পারবো কতো চামড়ায় ল্যাম্পি স্কিনের লক্ষণ রয়েছে। এ বছর সংগৃহীত ৩০ শতাংশ চামড়া নষ্ট—তবুও আমরা তা কিনেছি। আমি নিজেই সাড়ে সাত হাজার চামড়া সংগ্রহ করেছি। আমরা চাই না কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হোক। আপনি চাইলে আমার আড়তে এসেই দেখতে পারবেন।

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. আতোয়ার রহমান বলেন, রাজশাহীর কোনো হাটে ল্যাম্পি স্কিন রোগে আক্রান্ত গরু বিক্রি হয়নি। এই রোগ দৃশ্যমান, গরুর গায়ে বড় দাগ থাকলে যে কেউ সহজেই চিনতে পারবেন। আর এমন পশু কোরবানি করাও সম্ভব নয়।

রাজশাহী বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ দফতরের পরিচালক ডা. আনন্দ কুমার অধিকারী বলেন, চামড়া ব্যবসায়ীরা দাবি করছেন চামড়ায় রোগ আছে। কিন্তু তাদের কথার সঙ্গে বাস্তবতা মেলে না। হাট বা খামারে রোগাক্রান্ত পশু বিক্রির সুযোগ নেই। বিষয়টি আমরা মন্ত্রণালয়ে জানিয়েছি। অনুমতি পেলে নমুনা পরীক্ষা করে দেখব।


Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *