
নিজস্ব প্রতিবেদক:
ঢাকা: অবশেষে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশেনর (বিইআরসি) নতুন জনবল কাঠামোর দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়েছে। বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে জনবল কাঠােমা প্রধান উপদেষ্টা দপ্তরে প্রেরণ করা হয়েছে বলে বিইআরসির চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ নিশ্চিত করেছেন।
বিইআরসির চেয়ারম্যান বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. ফাওজুল কবির খান ৩০ এপ্রিল নতুন জনবল কাঠামো অনুমোদন দিয়েছেন। এখন প্রধান উপদেষ্টার অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘যদিও ২০১৭ সালে প্রস্তাবিত নতুন জনবল কাঠামোটি আমি পর্যাপ্ত বলে মনে করি না। আমি চাই বিইআরসি প্রো-অ্যাকটিভ রোল প্লে করুক। সেভাবে কাজ শুরু করা হয়েছে। আপনারা দেখেছেন ইতোমধ্যেই বিপিডিবিকে চিঠি দেওয়া হয়েছে কোন চুক্তি করার আগে যেনো বিইআরসির মতামত নেয়।’
বিইআরসির চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমরা সেখানে দেখবো ওই প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু। আর দেশের জনগণের স্বার্থে হচ্ছে কিনা। এসব কাজ করতে গেলে বিষয়ভিত্তিক দক্ষ লোকবল দরকার। বিইআরসিকে প্রো-অ্যাকটিভ করতে গেলে বিদ্যমান জনবল দিয়ে সম্ভব না। এমনকি প্রস্তাবিত জনবল দিয়েও পুরোপুরি সম্ভব না। এ জন্য বাড়তি এবং বিষয়ভিত্তিক লোকবল দরকার। এ জন্য গ্রাউন্ড ওয়ার্ক শুরু করেছি।’
অনুমোদনের অপেক্ষায় থাকা জনবল কাঠামোতে পরিবর্তন আনতে গেলে আবার পিছিয়ে যাবে উল্লেখ করে বিইআরসির চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘যে কারণে আমরা আর সেটিতে হাত দেই নি। আমরা অবিকল অনুমোদনের জন্য যোগাযোগ রেখেছি। এটা অনুমোদনের পরেই আবার আপডেটের উদ্যোগ নেওয়া হবে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৭ সালে বিইআরসির বিদ্যমান ৮১ পদের সঙ্গে আরও ২০০ পদসৃজন করে (২৮১ পদ) খসড়া জনবল কাঠামো তৈরি করা হয়। এরপর জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মতামতের জন্য প্রেরণ করে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সেটিকে কেটে ১১৮ নামিয়ে আনে। দুই বছর পর (২০১৯ সাল) দুই ধাপে নিয়োগের শর্তে অনুমোদন দেয় অর্থবিভাগ। এরপর আবার দুই বছর চলে যায়। ২০২১ সালের মার্চে প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটির বৈঠকে রাজস্ব খাতে ৬৫টি পদ অনুমোদন দেওয়া হয়। এতে পুর্বের ৮১ ও প্রস্তাবিত ৬৫ পদ মিলে ১৪৬ জনবলের কথা বলা হয়।
বিইআরসি ১৪৬ পদের দায়িত্ব বন্টন প্রস্তুত করে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী গ্রেড-৩ ও তদুর্ধ্ব পদ সৃষ্টিতে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন আবশ্যক। এরকম ৪টি পদ থাকায় ২০২১ সালের ৫ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে প্রেরণ করে। প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন না দিয়ে যৌক্তিকতার ব্যাখ্যা করতে বলেন। তারপর অন্ধকারে চলে যায় বিইআরসির জনবল কাঠামো। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর গত ১৮ জুলাই আবার বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়। প্রায় ৮ মাস পর প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরে প্রেরণ করার খবর পাওয়া গেছে।
বিইআরসি সুত্র জানিয়েছে, জনবল কাঠামো ঝুলে থাকায় বিইআরসিতে এক ধরণের স্থবিরতা ও অসন্তোষ রয়েছে। পদ না থাকায় একই পদে বছরের পর বছর পড়ে থাকায় অনেকের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে। আইন অনুযায়ী সহকারি পরিচালক পদে ১০ বছর কাজ করার পর উপপরিচালক পদে প্রমোশন হওয়ার কথা। কিন্তু ১৩ বছর চাকরি হয়ে গেছে কিন্তু প্রমোশন পাচ্ছেন না। আবার উপপরিচালক পদে ৩ বছরসহ প্রথম শ্রেণির পদে ১৫বছরের অভিজ্ঞতা থাকলে পরিচালক হওয়ার কথা। একজন কর্মকর্তা প্রথম শ্রেণির পদসহ উপপরিচালক পদে ২৬ বছর ধরে সার্ভিস দিয়ে আসছেন। যিনি আর মাত্র ২ মাস পর অবসরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কিন্তু প্রমোশন নামক সোনার হরিণ তার ভাগ্যে জোটেনি। এর রকম অসংখ্য নজির রয়েছে।
যে কারণে কমিশনে অনেক কর্মকর্তার মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে। আবার অনেকগুলো পদে প্রেষণে নিয়োগ পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে। দেখা যাচ্ছে পরিচালক গ্যাস দেওয়া হচ্ছে পেট্রোবাংলা অথবা গ্যাস কোম্পানিগুলো থেকে। একইভাবে পরিচালক বিদ্যুৎ নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে বিদ্যুতের কোম্পানি থেকে। যারা এখানে বসে বিতরণ কোম্পানিগুলোর আবেদন মূল্যায়ন করছেন। এখানে স্বার্থের সংঘাত নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই সোচ্চার ভোক্তাদের সংগঠন ক্যাব। দেখা গেছে যিনি পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানির অফিসার। তিনি প্রেষণে বিইআরসিতে বসে পশ্চিমাঞ্চল কোম্পানির গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব মূল্যায়ন করছেন। আরও আনেক ইস্যু রয়েছে যেগুলো ওই পদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক তবুও তাদের অফিসাররাই ধারাবাহিকভাবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
অন্তবর্তীকালীন সরকারের বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. ফাওজুল কবির খান প্রথম কর্মদিবসেই অনেকগুলো যুগান্তকারী সিদ্ধান্তের কথা জানান। ঘোষণা দেন, বিশেষ বিধান আইন বাতিল, নির্বাহী আদেশে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম সমন্বয় না করার। তার ওই ঘোষণা ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়, সাধুবাদ জানান ক্যাবসহ ভোক্তাদের সংগঠনগুলো। কয়েক দিনের মথায় ২৭ আগস্ট নির্বাহী আদেশে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম সমন্বয় করার ধারা বিলুপ্ত করা হয়। অনেকে আশাবাদী হয়ে ওঠেন ন্যুজ বিইআরসি গতিশীল ও শক্তিশালী হওয়ার। প্রায় ৯ মাস অতিবাহিত হলেও বিইআরসি শক্তিশালী হওয়ার অন্তরায়গুলো এখনও রয়েই গেছে।
আগের সরকার যে প্রবিধানমালার দোহাই দিয়ে জ্বালানি তেলের দাম নির্বাহী আদেশে নির্ধারণ করতো। সেগুলো এখনও ঝূলে রাখার পাথেই হাটছে। পনের দিনে কাজ ৮ মাসেও শেষ করা যায় নি। ২০১২ সাল থেকে ঝুলে থাকা প্রবিধানমালা অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রথম দিকে নাড়াচাড়া শুরু হলেও এখন আবার অন্ধকারে চলে গেছে। আগের সরকারের আমলাদের মতোই বর্তমান আমলারাও বিষয়টি ঝুলে রাখার পথেই হাটছে। জ্বালানি উপদেষ্টা প্রথম দিকে যতটা সিরিয়াস ছিলেন এখন তার আগ্রহেও ভাটার টান দেখছেন কেউ কেউ।
সম্প্রতি এফইআরবি আয়োজিত সেমিনারে উপদেষ্টা অনেকটা বিগত সরকারের সুরে কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, তেলের দাম বিইআরসির হাতে ছেড়ে দিলে কি হবে বিষয়টি নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। কারণ হঠাৎ করে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে গেলে কি দাঁড়াবে। তখন ভোক্তারা এটা বহন করতে পারবে কিনা।
বিদ্যুৎ এবং গ্যাসের দাম বিইআরসি নির্ধারণ করে থাকলেও সরকার ভর্তুকি দিয়ে থাকে। একই ফর্মুলায় তেলের দামও সমন্বয় করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে বলে মনে করেন বিইআরসির সাবেক চেয়ারম্যান ও কমিশনারগণ। আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়ে গেলে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বিপিসিকে ভর্তুকি দেবে সরকার। অনেকটা এভাবেই বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করে থাকে বিইআরসি। তবুও বিইআরসিকে পাশ কাটিয়ে নির্বাহী আদেশে দাম নির্ধারণ প্রক্রিয়া জারি রাখতে তৎপর আমলারা।