
মো: রফিকুল ইসলাম।
গত কয়েক মাস ধরে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ইরান ও ইসরায়েলের সম্ভাব্য যুদ্ধ নিয়ে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে। ড্রোন হামলা, ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ, সীমান্তে উত্তেজনা এবং কূটনৈতিক বাকযুদ্ধ—সবকিছুই যেন মধ্যপ্রাচ্যকে নিয়ে আবারও এক অস্থির বাস্তবতায় ঠেলে দিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দু আদতে কী? এটি কি সত্যিই দুই রাষ্ট্রের মধ্যকার রাজনৈতিক সংঘর্ষ, নাকি এর পেছনে রয়েছে ফিলিস্তিন ইস্যুকে বিশ্ববাসীর মনোযোগ থেকে দূরে সরিয়ে নেওয়ার এক কৌশলী প্রয়াস?
ফিলিস্তিন : এক দীর্ঘ রক্তাক্ত ইতিহাস
১৯৪৮ সাল থেকে ফিলিস্তিনের জনগণ অবিচার, দখল ও দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে আসছে। গাজা, পশ্চিম তীর এবং আল-কুদস শহরে ইসরায়েলি দখলদারিত্ব অব্যাহত রয়েছে। ২০২۳ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় শুরু হওয়া ভয়াবহ সামরিক অভিযান, যেখানে হাজার হাজার নিরীহ মানুষ নিহত হয়েছেন, বিশেষ করে নারী ও শিশুরা, তা মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে বিশ্বজুড়ে নিন্দিত হয়েছে।
তবে ২০২৪-এর শুরুর দিক থেকে দেখা গেল, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ফিলিস্তিন ইস্যু আস্তে আস্তে চাপা পড়ে যাচ্ছে। এর জায়গা নিচ্ছে ইরান ও ইসরায়েলের দ্বন্দ্ব। এই সময়টিতেই প্রশ্ন উঠছে—এই উত্তেজনা কি প্রকৃত যুদ্ধের অঙ্গসংগঠিত উপসংহার, নাকি এটি ফিলিস্তিন থেকে দৃষ্টি সরানোর একটি নিখুঁত নাট্য মঞ্চায়ন?
নাটকীয় উত্তেজনা : ইরান বনাম ইসরায়েল
ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই বৈরিতা রয়েছে। সিরিয়ায় ইরানের প্রভাব বিস্তার, লেবাননের হিজবুল্লাহর প্রতি ইরানের সমর্থন, কিংবা পরমাণু কর্মসূচি—সবই ইসরায়েলের উদ্বেগের কারণ। কিন্তু ২০২৪-২৫ সালে আচমকা যেভাবে এই উত্তেজনা তুঙ্গে ওঠে, তা অনেকটাই অস্বাভাবিক।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি ‘প্ল্যানড কনফ্রন্টেশন’—অর্থাৎ একটি কৃত্রিম সঙ্কট, যার মাধ্যমে বিশ্বের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়া যায় এমন একটি ইস্যু থেকে—যেমন ফিলিস্তিন।
ফিলিস্তিন থেকে নজর সরানোর কৌশল?
নিম্নোক্ত কিছু দিক এই প্রশ্নের পক্ষে যুক্তি তৈরি করে—
১. মিডিয়া কাভারেজে স্লিপ : গাজায় হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু, হাসপাতাল ধ্বংস, খাদ্য ও ওষুধ সংকট—এই ভয়াবহ মানবিক সংকট এখন আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় দ্বিতীয় সারির খবর হয়ে গেছে।
২.বিশ্বনেতাদের অবস্থান পরিবর্তন : ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের “ঝুঁকি” দেখিয়ে মার্কিন প্রশাসন এখন ইসরায়েলের প্রতি নতুন করে সমর্থন জানাচ্ছে। এতে ফিলিস্তিন ইস্যুর ওপর চাপ সৃষ্টি হ্রাস পাচ্ছে।
৩.আরব বিশ্বের নীরবতা : ইরান ও ইসরায়েলের সম্ভাব্য সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন আরব রাষ্ট্র ফিলিস্তিন প্রসঙ্গে তাদের আগের কড়া অবস্থান থেকে সরে এসেছে।
রাজনীতি ও নাট্যশিল্পের মিল কোথায়?
রাজনীতি অনেক সময় সরাসরি নাটকের মতো। যেখানে দর্শকের মনোযোগ ঘুরিয়ে দিতে হয় অন্যদিকে। মধ্যপ্রাচ্যে এই নাটক নতুন নয়। ইরাক যুদ্ধ, সিরিয়া সংকট, আফগানিস্তানে মার্কিন হস্তক্ষেপ—সবসময় বড় কোনো ঘটনা ঘটলে ফিলিস্তিন ইস্যু চাপা পড়ে যায়।
এবারও কি তেমন কিছু হচ্ছে?
পরিশেষে-
ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ বাস্তব কিনা, তা ভবিষ্যতের ক্যানভাসে আঁকা হবে। কিন্তু এটুকু পরিষ্কার, ফিলিস্তিন ইস্যু আজ আবারও এক প্রান্তে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এটি শুধু রাজনৈতিক নয়, এক আন্তর্জাতিক মনস্তাত্ত্বিক খেলাও বটে।
এই খেলায় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তারা হলো গাজার সেই নিষ্পাপ শিশুরা, যাদের চোখে যুদ্ধ নয়, শান্তির স্বপ্ন ছিল!
যদি দৃষ্টি ফিরিয়েই রাখতে হয়, তবে তা নির্যাতনের বিরুদ্ধে হওয়া উচিত—নাটকীয়তার পেছনে নয়।”