
সম্পাদকীয়
আধুনিক সভ্যতার কণ্ঠে যখন ‘মানবিক সহায়তা’ শব্দটি উচ্চারিত হয়, তখন তা যেন আজকের পৃথিবীর সবচেয়ে নির্মম পরিহাসে রূপ নিয়েছে। বিশেষ করে ফিলিস্তিনের নিরস্ত্র শিশু, নারী, এবং সাধারণ মানুষের উপরে চলমান সহিংসতা ও গণহত্যা এ সত্যকে এতটাই নগ্ন করে তুলেছে যে, ভাষা সেখানে লজ্জিত, বিবেক সেখানে মৃত, আর মানবতা — কেবল লাশের সংখ্যার সমার্থক।
বর্তমান ফিলিস্তিন সংকটে পশ্চিমা বিশ্বের ‘মানবিক সহায়তা’র যে নাটক আমরা প্রত্যক্ষ করছি, তা মূলত একটি পরিকল্পিত, কৌশলগত এবং রাজনৈতিক ভণ্ডামি। একদিকে ইসরায়েলের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও বোমাবর্ষণের ছত্রছায়ায় হাজারো ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে যাচ্ছে, খাদ্যপণ্য, ওষুধ, জ্বালানী—সবকিছু রুদ্ধ করে রাখা হচ্ছে। অপরদিকে একই রাষ্ট্র কিংবা তাদের মিত্ররাই আকাশপথে ‘মানবিক সাহায্য’ ফেলার নাম করে ফিলিস্তিনিদের উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দিচ্ছে কিছু শুকনো বিস্কুট, ছেঁড়া কম্বল, কিংবা খালি পানির বোতল! এ কেমন সহানুভূতি? যেখানে শিশুর কান্না থেমে গেছে চিরতরে, সেখানকার আকাশে মানবতা কী করে প্যারাশুটে নেমে আসে?
বিশ্ব মোড়লদের দ্বিমুখী নীতির এই এক নির্মম প্রতিচ্ছবি। মানবিক সহায়তার নামে তারা নিজেদের হাত ধোয়ার সুযোগ নিচ্ছে, আর গণমাধ্যমে ছবি ছড়িয়ে দিয়ে নিজেদেরকে পরোপকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে। অথচ এই সহায়তাগুলোর উৎস কোথা থেকে আসে? যে রাষ্ট্র অস্ত্র সরবরাহ করে, যুদ্ধ চালায়, মানবাধিকার লঙ্ঘনে ইন্ধন দেয় — সেই রাষ্ট্রই আবার ‘সহানুভূতিশীল’ মুখোশ পরে সহায়তার হাত বাড়ায়!
এখানে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য: এই ভণ্ডামি কবে থামবে? মানবতা কি কেবল বক্তৃতার শব্দ হয়ে থাকবে? জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক রেড ক্রস, এমনকি তথাকথিত সভ্য রাষ্ট্রগুলোর মুখ থেকে যেসব ‘উদ্বেগ’ আর ‘নিন্দা’ শোনা যায়, তা কি কেবল বুলির ফুলঝুরি?
ফিলিস্তিনে আজ যা ঘটছে, তা একটি গণহত্যা, একটি মানবিক বিপর্যয় — এবং বিশ্বের চোখের সামনে তা দিবালোকে সংঘটিত হচ্ছে। এই মুহূর্তে দরকার সত্যিকারের চাপ, রাজনৈতিক অবস্থান, কার্যকর অবরোধ ও প্রতিরোধ—not কৃত্রিম সহানুভূতির খণ্ড খণ্ড প্যাকেট।
আজ মানবতা নিজের মুখ দেখে লজ্জা পায়। কারণ, তার নাম ব্যবহার করে চালানো হচ্ছে লাশের ব্যবসা। ফিলিস্তিনের মৃত শিশুর মুখে বিস্কুট তুলে মানবিকতা প্রমাণ হয় না। সে শিশুটি বেঁচে থাকলে মানবতা প্রমাণ হতো।
সুতরাং, এখনই সময় এই বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া ভণ্ডামির মুখোশ ছিঁড়ে ফেলার। মানবিক সহায়তা যদি হয় শর্তযুক্ত, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, কিংবা শুধুই দায়মোচনের হাতিয়ার — তবে তা আর সহায়তা নয়, বরং আরেক প্রকার সহিংসতা।
ফিলিস্তিনের দিকে চেয়ে বলি — মানবিক সহায়তার নামে লাশ নয়, চাই প্রকৃত ন্যায়বিচার।