ভরা মৌসুমেও বাড়ছে চালের দাম

Spread the love

নিউজ ডেস্ক, জনতারকথা।

রেকর্ড চাল উৎপাদন হলেও এর সুফল পাচ্ছেন না কৃষক ও ভোক্তারা। ভরা মৌসুমে কম দামে চাল পাওয়ার কথা থাকলেও দেশের বাজারগুলোতে হঠাৎই কেজিপ্রতি ৪ থেকে ৫ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে বিভিন্ন জাতের চালের দাম। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, প্রধান খাদ্য শস্য চালের এই মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়ছে অন্য নিত্যপণ্যেও। ফলে এই সময়ে সাধারণ মানুষের স্বস্তির পরিবর্তে বেড়েছে দুশ্চিন্তা। চলমান অর্থনৈতিক মন্দার মাঝেই এই মূল্যবৃদ্ধি নিম্নআয়ের মানুষের জীবন-জীবিকার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অন্যদিকে, বর্ধিত উৎপাদন খরচে ধান ফলিয়ে কম দামে বিক্রির পর মিলারদের হাত ঘুরে বাজারে উচ্চমূল্যে চাল বিক্রিতে হতাশ কৃষকরাও। এ ধরণের কারসাজি সাধারণের নাভিশ্বাসের সঙ্গে কৃষকদের মনেও ফেলছে বিরূপ প্রভাব।

চালের এই হঠাৎ মূল্যবৃদ্ধির পেছনে কর্পোরেট কারসাজিকেই বহুলাংশে দুষছেন সংশ্লিষ্টরা। বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, করপোরেট হাউজগুলো বিভিন্ন বড় বড় মোকাম থেকে শত শত টন চাল মজুত করছে। এখন বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে মূল্য বৃদ্ধি করছে। যার ফলে চট্টগ্রামসহ দেশের বড় চালের আড়তে বেড়েই চলেছে চালের দাম। এর প্রভাবে মোটা চালের দামও কেজিপ্রতি ৬০ টাকার বেশি।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট চালের প্রায় ৫৫ শতাংশ বোরো মৌসুমে উৎপাদন হয়। ফলন ভালো হলে সরবরাহ বাড়ে, আর বাজারে দাম কমে। এ বছর বোরোতে রেকর্ড ২ কোটি ১৪ লাখ টন চাল উৎপাদন হয়েছে।

গতকাল রাজধানীর কয়েকটি খুচরা বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরু বা মিনিকেট চালের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৭৫ থেকে ৮৫ টাকা দরে। এ ছাড়া মাঝারি (বিআর-২৮) মানের চালের কেজি ৫৮ থেকে ৬৩ টাকা, মোটা চালের কেজি ৫৫ থেকে ৫৮ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা জানান, গত এক সপ্তাহে সরু ও মোটা চালের কেজিতে ৫ টাকা পর্যন্ত দর বেড়েছে। এ ছাড়া মাঝারি (বিআর-২৮) মানের চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ৪ টাকা।

চালের দাম বৃদ্ধির প্রমাণ দিচ্ছে সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) প্রতিবেদনও। সংস্থাটির তথ্য বলছে, গত এক মাসে সরু চালের দাম বেড়েছে ৫ শতাংশ। এ ছাড়া মাঝারি ও মোটা চালের দর বেড়েছে ৯ শতাংশের বেশি। তবে এক বছরের ব্যবধানে এসব চালের দাম গড়ে বেড়েছে ১৫ শতাংশ।

খাদ্যের মজুত গত বছরের এই সময়ের চেয়ে এখনও বেশি। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, এখন দেশের বিভিন্ন গুদামে খাদ্য মজুত আছে ১৭ লাখ ৬৮ হাজার ২৭৬ টন, যার মধ্যে চাল ১৩ লাখ ৮২ হাজার ৭৭৫ টন ও গম ২ লাখ ৩৯ হাজার ৪১৬ টন। এ ছাড়া ধানের মজুত রয়েছে ২ লাখ ২৪ হাজার ৭৪৫ টন। বর্তমানে খাদ্যের এই মজুত গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ৩ লাখ টন বেশি।

নোয়াখালীর সুবর্ণচরের মোহাম্মদপুর ইউনিয়নের কৃষক আব্দুর রব বলেন, ‘ধান বিক্রি করে এখন আফসোস করছি। এক মাস আগে ১০০০-১১০০ টাকায় ধানের মণ বিক্রি করলাম। এখন শুনি, চালের দাম কেজিতে ৮ টাকার মতো বেড়েছে। আমরা ধান থেকে কেজিপ্রতি এক-দেড় টাকা বেশি পেলেও মিলাররা চালে ৮ টাকা লাভ করল।’

নওগাঁ চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন বলছেন, বৃষ্টির কারণে ধানের গুণগত মান কিছুটা নষ্ট হয়েছে, এতে দাম বেড়েছে। গত ১৫ থেকে ২০ দিনে মণপ্রতি ধানের দাম ১০০ থেকে ১৫০ টাকা বেড়েছে। এর ফলে মিল পর্যায়ে চালের দাম ২ থেকে ৩ টাকা বেড়েছে।

তবে বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, দাম বাড়ানোর জন্য দায়ী করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো। তারা ঈদের আগেই কৃষকের কাছ থেকে কম দামে ধান কিনে মজুত করেছে এবং এখন কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে দাম বাড়াচ্ছে।

বাংলাদেশ চালকল মালিক সমিতির প্রচার সম্পাদক জয়নাল আবেদিন বলেন, ৮৫ শতাংশ মিলারের সংরক্ষণ ক্ষমতা নেই। তবে বড় করপোরেট চালকলগুলো তিন থেকে চার মাসের ধান মজুত করে। পরে তারাই বাজারে সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়ায়।

চালের বাজারে অস্থিরতা নিয়ে সরকার কিছু উদ্যোগ নিলেও ফল এখনও দৃশ্যমান নয়। গত সপ্তাহে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও জেলা খাদ্য বিভাগ চালের বাজারে অভিযান চালায়। তবে পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই অভিযান শুধু খুচরা পর্যায়ে। মিলগেট আর গুদামে নজরদারি দুর্বল।

বৃহস্পতিবার সিন্ডিকেট করে চালের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করে ‘চট্টগ্রাম নাগরিক সমাজ’। এতে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ ও সংগঠনের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।

চট্টগ্রামের চাল ব্যবসায়ীরা বলেন, চালের বাজারে অস্থিরতার পেছনে রয়েছে করপোরেট হাউজগুলোর ‘কালোহাত’। দেশে করপোরেট হাউজগুলো উৎপাদিত চালের বেশিরভাগ বিভিন্ন মোকাম থেকে কিনে নিচ্ছে। তারা ইচ্ছা হলেই সেই চাল বাজারে ছাড়ছে। না হলে মজুত করছে। এ কারণে সংকট সৃষ্টি হচ্ছে।

তারা বলছেন, ১৫ দিন আগে যে মোটা চালের (স্বর্ণা) কেজি ৫১-৫২ টাকা ছিল তা এখন ৫৫-৬০ টাকা। মাঝারি মানের চালের (পাইজাম ও বিআর-২৮) কেজি ৬২-৬৫ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৭০-৭২ টাকা। কয়েক দিনের মধ্যে বাজারে সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে মাঝারি মানের চালের।

কেজিপ্রতি মাঝারি মানের চালের দাম ৫ থেকে ৮ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। খুচরা বাজারে জাত ও মানভেদে চিকন চাল নাজিরশাইল ৮২ থেকে ৮৫ টাকা, মিনিকেট ৮০ থেকে ৮৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর মাঝারি মানের বিআর ২৮ ও ২৯ চাল ৬২ থেকে ৬৫ টাকা এবং গুটি, চায়না ইরিসহ মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৮ থেকে ৬০ টাকায়। যা আগে প্রতি কেজিতে ৪ থেকে ৫ টাকা পর্যন্ত কম ছিল।

খাতুনগঞ্জের চাল ব্যবসায়ী কামাল উদ্দিন বলেন, উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন মোকাম থেকে করপোরেট হাউজগুলো চাল কিনে মজুত করে রাখছে। এ কারণে চালের বাজারে সরাসরি প্রভাব পড়ছে। ফলে প্রতিদিনই চালের দাম বাড়ছে। প্রশাসনের উচিত করপোরেট হাউজগুলোর মজুত তদারকি করা।

গত বুধবার বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল মিলনায়তনে কৃষি মন্ত্রণালয়ে এক সভায় কৃষি উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, সরকার দাম নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছে। কৃষকের ফসল মধ্যস্বত্বভোগীদের হাত থেকে রক্ষায় এবার সরকার কৃষকদের কাছ থেকে ফসল কেনার নির্ধারিত সময় ১৫ দিন এগিয়ে এনেছে। তবে আমাদের সমস্যা হচ্ছে দুর্নীতি।


Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *