
আন্তর্জাতিক ডেস্ক।
ইরানে হামলা করে ফেরার পথে গাজায় অব্যবহৃত বোমা ফেলেছে ইসরায়েল। শুরুতে এই পরিকল্পনা ছিল তাৎক্ষণিক। পরে তা নিয়মিত কৌশলে পরিণত হয়। এতে গাজায় হামলার মাত্রা কমেনি, বরং ইরান অভিযানের আড়ালেও গাজায় চলতে থাকে তীব্র হামলা। এসব হামলায় ১৩ থেকে ২৪ জুন পর্যন্ত সময়ে গাজায় শতাধিক বেসামরিক নাগরিক নিহত হন।
সামরিক একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, অভিযানের প্রথম দিন থেকেই ইসরায়েলের যুদ্ধবিমানের পাইলটরা বাড়ি ফেরার পথে হামাসকে লক্ষ্য করে ফেলে যাওয়া গোলাবারুদ ব্যবহারের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। আইডিএফের (ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী) গ্রাউন্ড কমান্ডাররা প্রস্তাবটি গ্রহণ করে বিমানগুলোকে লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করে দেন।
এরপর পুরো যুদ্ধের সময় এই কৌশল আরও বিস্তৃতভাবে ব্যবহার করা হয়। এতে করে গাজায় বিমান হামলার মাত্রা কমেনি, একই সঙ্গে দ্বিমুখী অভিযান চালিয়ে গেছে ইসরায়েল। আইডিএফ জানিয়েছে, শুরুতে পরিকল্পনাটি তাৎক্ষণিকভাবে নেওয়া হলেও পরে প্রতিটি হামলা নির্ধারিত লক্ষ্যবস্তুতে পরিকল্পিতভাবেই চালানো হয়।
১৩ থেকে ২৪ জুন পর্যন্ত সময়ে ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ নামে ইরান অভিযানে ব্যস্ত ছিল ইসরায়েল। ওই সময়েও গাজা ছিল রক্তাক্ত। বিশেষ করে গুলিবর্ষণ ও বিমান হামলার ঘটনায় নিহত হন বহু বেসামরিক মানুষ। হতাহতের সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি। তবে শত শত মানুষের প্রাণহানির কথা নিশ্চিত করেছে একাধিক সংস্থা। ১৮ জুন ওয়াফা সংবাদ সংস্থা জানায়, আইডিএফের এক বিমান হামলায় মাগাজি শরণার্থী শিবিরে এক নারী ও শিশুসহ ১০ জন নিহত হন। একই দিনে খান ইউনিসের আল-আত্তার তাঁবু এলাকায় আরেকটি হামলায় প্রাণ যায় পাঁচজনের।
ধারণা করা হয়, ইসরায়েলি বিমানবাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল তোমের বার এই অবশিষ্ট অস্ত্র ব্যবহারের সিদ্ধান্ত জেনেই তা আরও বিস্তৃতভাবে প্রয়োগের নির্দেশ দেন। ইরান অভিযানে আইডিএফ দ্রুত আকাশে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। তারা ইসলামি প্রজাতন্ত্রটির পারমাণবিক কর্মসূচির সঙ্গে জড়িত স্থাপনাগুলোকে লক্ষ্য করে আঘাত হানে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ইসরায়েলি বিমানগুলো ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের উৎক্ষেপণস্থলগুলো ধ্বংস করতে থাকে, যাতে ইসরায়েলের অভ্যন্তরে হামলার আশঙ্কা কমানো যায়।
ইরানে ইসরায়েলি অভিযানে যুক্তরাষ্ট্রের সাফল্য কাজে লাগিয়ে গাজা যুদ্ধ থামাতে উদ্যোগ নিচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন- উভয় পক্ষেই সম্ভাব্য যুদ্ধবিরতি ও জিম্মিমুক্তির একটি চুক্তি নিয়ে নতুন করে আশাবাদ তৈরি হয়েছে। সূত্র জানিয়েছে, হামাসও যুদ্ধবিরতি কাঠামো নিয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে। একই সঙ্গে ইসরায়েলি পক্ষও প্রথমবারের মতো ‘চিরতরে যুদ্ধের অবসান’ সংক্রান্ত আলোচনায় আগ্রহ দেখাচ্ছে।
গত বৃহস্পতিবার বিভিন্ন সূত্রে সম্ভাব্য চুক্তির খসড়া প্রকাশিত হয়। মিসরের সংবাদমাধ্যম ‘আল-রাদ’ জানায়, গাজা থেকে ইসরায়েলি সেনা আংশিকভাবে সরে যাবে। আর জিম্মিমুক্তির সঙ্গে সঙ্গেই একটি স্থায়ী চুক্তি নিয়ে আলোচনা শুরু হবে। এতে যুক্তরাষ্ট্র গ্যারান্টি দেবে। চূড়ান্ত আলোচনায় থাকবে সব জিম্মির মুক্তি, যুদ্ধবিরতি এবং যুদ্ধপরবর্তী শাসনব্যবস্থার কাঠামোর মতো বিষয়।
প্রথম দিনে আটজন জীবিত জিম্মি, সপ্তম দিনে পাঁচটি মৃতদেহ, ৩০তম দিনে আরও পাঁচটি মৃতদেহ, ৫০তম দিনে দুজন জীবিত জিম্মি এবং ৬০তম দিনে আরও আটটি মৃতদেহ ফেরত দেওয়া হবে বলে খসড়ায় উল্লেখ রয়েছে। তবে গত মার্চে যুদ্ধবিরতি ভেঙে যাওয়ার পর নানাভাবে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে বিভিন্ন পক্ষ।
হামাস বারবার বলেছে, ‘যেকোনো জিম্মিমুক্তির চুক্তির সঙ্গে গাজা থেকে ইসরায়েলের সেনা প্রত্যাহার এবং যুদ্ধের স্থায়ী অবসান নিশ্চিত করতে হবে।’
ইসরায়েলের পক্ষ থেকে এই দাবির প্রতি সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি না থাকায় সেসব প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে হামাস। তবে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে এখন কিছুটা নমনীয় মনে হচ্ছে। তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন, ‘হামাসকে ধ্বংসের চেয়ে জিম্মিদের ফিরিয়ে আনা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’ যদিও বিভিন্ন সময়ে তিনি হামাসের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানও নিয়েছেন। জানা গেছে, নেতানিয়াহু ও তার প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ এই পরিকল্পনার প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। জিম্মিদের পরিবার এতে আশান্বিত হয়ে উঠেছে। ধারণা করা হচ্ছে, এখনো ২০ থেকে ২২ জন জিম্মি জীবিত আছেন, আর হামাসের হাতে রয়েছে অন্তত ২৮ জনের মৃতদেহ।
নেতানিয়াহুর ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা রন ডার্মার সম্প্রতি ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক দূত স্টিভ উইটকফ ও কাতারের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। নেতানিয়াহু চলতি সপ্তাহেই ওয়াশিংটনে যাচ্ছেন। অনেকে ধারণা করছেন, এই সফরেই হয়তো চুক্তির বিষয়ে নীতিগত ঘোষণা হতে পারে। ঘোষণা হলে আনুষ্ঠানিক ও কারিগরি আলোচনা সম্ভবত কাতার অথবা মিসরের মধ্যস্থতায় আরও এক সপ্তাহ সময় নিতে পারে। তবে এই প্রক্রিয়ায় কোনো অগ্রগতি না হলে হামাস প্রতিনিধিদের বহিষ্কার করতে কাতারকে চাপ দিতে আমেরিকার সহায়তা চেয়েছে ইসরায়েল।
ইতোমধ্যে কাতার হামাসকে ব্যক্তিগত অস্ত্র সমর্পণের নির্দেশ দিয়েছে। যদিও ইসলামপন্থিদের কাছে এটি অপমানজনক মনে হচ্ছে। তবু অনেকেই এটিকে একটি ইতিবাচক প্রতীকী বার্তা হিসেবে দেখছেন। দীর্ঘদিন ধরে হামাসের প্রতি সহানুভূতিশীল কাতার এখন বাস্তব চাপে এসেছে। ইসরায়েলি নেতারা আশা করছেন, ট্রাম্পের ঘোষণায় ‘গাজা উচ্ছেদ করে একে মধ্যপ্রাচ্যের রিভেরা’ বানানোর হুমকি এখন হয়তো হামাস নেতাদের প্রভাবিত করতে পারে, যারা এখনো চুক্তিতে অনিচ্ছুক।
গত বুধবার রাতে খবর এসেছে, হামাস এবার জিম্মিমুক্তির কোনো আনুষ্ঠানিক অনুষ্ঠান করবে না। এর আগে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির যুদ্ধবিরতির সময় তারা জিম্মিদের ক্যামেরার সামনে এনে অভিনয় করিয়েছিল। যেটি নিয়ে ইসরায়েলে ব্যাপক ক্ষোভ ও আন্তর্জাতিক সমালোচনা তৈরি হয়েছিল। এস্তোনিয়ায় এক সংবাদ সম্মেলনে ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিদিওন সা’আর বলেন, ‘কিছু ইতিবাচক লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।’ ইসরায়েলি জনগণও যুদ্ধ শেষ দেখতে চায়। যদিও ৭ অক্টোবরের হামলায় জড়িত বাহিনীর তুলনায় হামাস এখন অনেক দুর্বল। তবুও গাজার ধ্বংসস্তূপের নিচে তারা এখনো আইডিএফের বিরুদ্ধে লড়ছে।
সূত্র: দ্য টেলিগ্রাফ