
সম্পাদকীয়:
বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় “এনসিপির ঘাড়ে আওয়ামী লীগ” বাক্যটি কেবল একটি রূপক নয়—এটি হয়ে উঠেছে আমাদের গণতান্ত্রিক কাঠামোর একটি অপ্রিয় প্রতিচ্ছবি। রাজনৈতিক সমঝোতা, নির্বাচনী ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা, জনগণের অংশগ্রহণ এবং প্রকৃত গণতান্ত্রিক চর্চার প্রশ্নে এ বিষয়টি আমাদের জাতীয় আত্মপরিচয়ের দিকে একটি কঠিন প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়: আমরা আসলে কি অর্জন করেছি?
এক নজরে প্রেক্ষাপট
আওয়ামী লীগ, স্বাধীনতার পর দেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিরোধী দলগুলোর সাথে যে আচরণ করেছে, তাতে তাদের গণতান্ত্রিক অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেওয়ায় নির্বাচন কার্যত একতরফা রূপ নেয়। এ পরিস্থিতিতে সরকারের বৈধতা রক্ষা ও আন্তর্জাতিক চাপ সামাল দিতে “জাতীয় পার্টি”, “নতুন রাজনৈতিক জোট” কিংবা “এনসিপি” নামধারী অপ্রতিষ্ঠিত দলগুলোকে সামনে এনে একটি প্রতিযোগিতার ছায়া তৈরি করা হয়।
এই এনসিপি—যাদের রাজনৈতিক ভিত্তি দুর্বল, জনসমর্থন সীমিত এবং কার্যত সরকারের ছায়ায় টিকে থাকা—তাদের ঘাড়ে চড়ে নির্বাচনের বৈধতা, সংসদীয় বিরোধী দলের মুখোশ কিংবা “গণতন্ত্রের রঙিন চিত্র” আঁকার যে চেষ্টা চলছে, তা কতটা অর্থবহ?
গণতন্ত্রের ছদ্মবেশ
গণতন্ত্রের সৌন্দর্য নিহিত থাকে মতবিনিময়, বিতর্ক, বিকল্প চিন্তাধারার উপস্থিতিতে। কিন্তু যদি বিরোধী দল শুধু নামমাত্র বিরোধী হয়, কিংবা সরকারেরই একপ্রকার প্রলম্বিত হাত হয়ে ওঠে, তখন সেই গণতন্ত্র একরকম তামাশায় পরিণত হয়। এনসিপির মতো দলগুলোর উপস্থিতি রাজনৈতিক বৈচিত্র্য নয়, বরং নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অর্জন না, ব্যর্থতার দলিল
আমরা যদি প্রশ্ন করি—এই ব্যবস্থার মাধ্যমে আমরা কী অর্জন করলাম?
উত্তর কঠিন কিন্তু স্পষ্ট:
একটি বিশ্বাসযোগ্য, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নয়।
জনগণের প্রকৃত মতামতের প্রতিফলন নয়।
বরং পেয়েছি আস্থা সংকটে ভোগা একটি রাজনৈতিক কাঠামো, যেখানে রাজনীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে নিয়ন্ত্রিত নাটকের মঞ্চ।
জুলাই আগস্ট এর আন্দোলনে ঝরে পড়া অসংখ্য প্রাণের রক্তের সঙ্গে, এবং যারা আহত হয়েছেন তাদের সঙ্গে বেইমানী করা!
আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো, গণতান্ত্রিক স্বচ্ছতা ও মানবাধিকারের প্রশ্নে বারবার উদ্বেগ জানিয়েছে। কিন্তু এনসিপি টাইপের “ডিজাইন করা বিরোধী দল” এই উদ্বেগ মেটাতে পারছে না। বরং এটি আরও স্পষ্ট করছে যে দেশে একটি ভারসাম্যহীন, একপাক্ষিক রাজনৈতিক পরিবেশ বিরাজ করছে।
সামনে কী?
দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে একটি বাস্তব, কার্যকর রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরির ওপর। প্রয়োজন একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ব্যবস্থা, নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন, এবং সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। এনসিপির মতো কৃত্রিম বিরোধীদল দিয়ে সে লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়।
উপসংহার:
এনসিপির ঘাড়ে আওয়ামী লীগ উঠে আদতে যে অর্জন করেছে তা শুধুই নিজস্ব শাসন বৈধতা রক্ষার কৌশল। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা, রাজনৈতিক ন্যায্যতা, এবং গণতন্ত্রের মৌলিক চেতনা—সবই সেখানে বিসর্জিত। এই পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী হলে দেশের ভবিষ্যৎ শুধু অস্থিরই নয়, গণতন্ত্রহীনতার অন্ধকার গলিতেও ঢুকে যেতে পারে। এখন সময়, প্রশ্ন করার—এই পথে আমরা কতদূর যাব, আর কত কিছু হারাব