
স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট।
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে নীতিগত ও চূড়ান্তভাবে অনুমোদন লাভ করার পর ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধনী অধ্যাদেশ-২০২৫ এর খসড়া শিগগির গেজেট আকারে প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে। মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের পর দ্রুততম সময়েই এটি অধ্যাদেশ আকারে প্রকাশিত হবে।
গত রোববার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে চূড়ান্ত অনুমোদন লাভ করা খসড়া অধ্যাদেশে পুলিশকে যেকোনো অভিযোগ এজাহার হিসেবে আমলে নেওয়ার আগে ‘প্রাথমিক অনুসন্ধানের ক্ষমতা’ দেওয়া হয়েছে। অন্তবর্তী সরকারের এই উদ্যোগ প্রশংসিত হলেও আইনটির অপপ্রয়োগ বন্ধে গঠনমূলক পরামর্শও দিয়েছেন অনেকে।
সংশোধনীর ফলে অস্পষ্ট, গুজব, মিথ্যা বা হয়রানিমূলক অভিযোগ সরাসরি মামলা হিসেবে রেকর্ড করা যাবে না। একই সঙ্গে মামলা তদন্তাধীন অবস্থায় কোনো অভিযুক্তের বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণ না থাকার বিষয়টি যদি ‘অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদনে’ উঠে আসে, তাহলে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দ্রুত মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে।
আইন মন্ত্রণালয় বলছে, বিচারিক দীর্ঘসূত্রিতা এবং মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলার জট কমাতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সংশোধনী একদিকে যেমন মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা রুখে দিয়ে বিচার ব্যবস্থার উপর মামলার চাপ কমাবে, একইভাবে এর অপপ্রয়োগের ঝুঁকিও রয়েছে।
আইনজ্ঞরা বলেছেন, পুলিশ প্রভাবশালী অভিযুক্তদের বাঁচাতে বা সাধারণ মানুষের বৈধ অভিযোগও ‘হয়রানিমূলক’ বলে প্রতিবেদনে তুলে দিতে পারে। নতুন আইনের এই প্রয়োগ অত্যন্ত স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। অন্যথায় এটি ন্যায়বিচার পাওয়ার পথে নতুন বাধা তৈরি করবে।
আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, সারা দেশে মিথ্যা মামলা ও গণগ্রেপ্তার বন্ধে সরকার কঠোর হচ্ছে। উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তের আলোকে ফৌজদারি কার্যবিধিতে এই সংশোধনী আনা হচ্ছে। এই উদ্যোগের ফলে দেশে হয়রানিমূলক মামলার প্রবণতা কমবে এবং বিচারিক প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা বাড়বে।
আইন উপদেষ্টা বলেন, নতুন বিধানে বলা হয়েছে, কমিশনার, এসপি বা এসপি পদমর্যাদার কোনো পুলিশ কর্মকর্তা তার নিয়ন্ত্রণাধীন কোনো মামলার বিষয়ে যদি মনে করেন, তদন্ত কর্মকর্তার কাছে প্রাথমিক প্রতিবেদন চাওয়া যৌক্তিক, তাহলে তিনি তা চাইতে পারবেন। প্রতিবেদন প্রস্তুত হলে তখন তা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেবেন। ম্যাজিস্ট্রেট যদি দেখেন, মামলায় কোনো আসামিকে বিনা অপরাধে জড়ানো হয়েছে, যার বিরুদ্ধে যথাযথ কোনো প্রমাণ নেই, তখন তিনি (ম্যাজিস্ট্রেট) সঙ্গে সঙ্গে তাকে (বিনা অপরাধে জড়ানো ব্যক্তি) মুক্তি দিতে পারবেন।
পুলিশের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এই অধ্যাদেশ বা বিধানের ফলে অহেতুক মামলার বোঝা থেকে পুলিশ এবং আদালত উভয়ই মুক্তি পাবে। অনেক সময় ব্যক্তিগত শত্রুতা বা হয়রানির উদ্দেশ্যে মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করা হয়। যার ফলে নিরপরাধ ব্যক্তিদের বছরের পর বছর ধরে ভোগান্তি পোহাতে হয়। নতুন এই বিধান প্রয়োগে সেই প্রবণতা কমবে বলে মনে করেন।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট শিশির মনির বলেন, ‘‘দেশের হয়রানিমূলক মামলা ও অহেতুক গ্রেফতার বন্ধে বিচার অঙ্গনের জন্য একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এর ফলে মামলার আগে প্রাথমিক অনুসন্ধানের কারণে একদিকে মামলা কমবে, অন্যদিকে ‘অন্তর্বর্তীকালীন’ প্রতিবেদনের মাধ্যমে নির্দোষ ব্যক্তিদের দ্রুত অব্যাহতি দেওয়ার সুযোগ থাকবে।’’ তবে কোনো প্রভাবশালী মহল যাতে হস্তক্ষেপ করতে না পারে সেজন্য একটি স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনের বিকল্প নেই বলেও মনে করেন এই আইনজীবী।
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন মানবাধিকারকর্মী বলেন, মামলা গ্রহণের আগে পুলিশের হাতে প্রাথমিক অনুসন্ধানের ক্ষমতা দেওয়ার বিষয়টি বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। এর মাধ্যমে পুলিশ প্রভাবশালী অভিযুক্তদের বাঁচাতে বা সাধারণ মানুষের বৈধ অভিযোগও ‘হয়রানিমূলক’ বলে প্রতিবেদনে চালিয়ে দিতে পারে। এই ধরনের ঝুঁকি থেকেই যায়। নতুন আইনে পুলিশের ক্ষমতার এই ব্যবহার অত্যন্ত স্বচ্ছতা সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
তবে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংস্কারের যে উদ্যোগ নিয়েছে, তার বেশিরভাগই পুলিশ ও বিচার বিভাগকে ঘিরে। তিনটি অগ্রাধিকার ঠিক করা হয়েছে: অভিযুক্তদের স্বচ্ছ বিচার নিশ্চিত করা, মামলার অচলাবস্থার কারণগুলো চিহ্নিত করা এবং বিচার বিভাগের জবাবদিহি নিশ্চিত করা।
আইন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, প্রস্তাবিত অধ্যাদেশের খসড়ার ওপর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, পুলিশ, মানবাধিকারকর্মী, সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইন বিশেষজ্ঞ ও বিভিন্ন অংশীজনের মতামত নেওয়া হয়েছে। গত ২ জুন রাজধানীর বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের সেমিনার হলে অংশীজনের সঙ্গে মতবিনিময় করেন আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। মতবিনিময় সভায় আইন অঙ্গনের অন্তত ২৬জন প্রতিনিধি অংশ নেন।
তাদের মতামত ও পরামর্শ পর্যালোচনা করে খসড়া পরিমার্জন করা হয়। পরিমার্জিত খসড়াসহ একটি সারসংক্ষেপ গত ২৬ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠায় আইন মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সময়ের স্বল্পতার কারণে খসড়া অধাদেশটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের আইনের খসড়া পরীক্ষা-নিরীক্ষাপূর্বক মতামত প্রদান-সংক্রান্ত আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটিতে উপস্থাপন করা হয়নি। ফৌজধারী বিচার ব্যবস্থাকে জনবান্ধব ও হয়রানিমুক্ত করতে বহু বছরের পুরনো এই আইনটি সময়োপযোগী ও সংশোধন সমীচীন হয়ে পড়ায় এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
ফৌজদারি কার্যবিধির সংশোধনীর বিষয়টি জনসমক্ষে আনার পর থেকেই এনিয়ে বিস্তর আলোচনা ও চুলচেরা বিশ্লেষণ হচ্ছে গণমাধ্যমসহ সামাজিক ও আইনি পরিমণ্ডলে। দৈনিক জনকণ্ঠের সাম্প্রতিক এক সম্পাদকীয়তে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘সতর্ক থাকতে হবে, কোনো অসাধু পুলিশ সদস্য যেন অর্থের বিনিময় অপরাধীকে ছেড়ে না দেয়। পুলিশকে সুনিশ্চিত করতে হবে যে, তদন্তকারী কর্মকর্তা জবাবদিহির ঊর্ধ্বে নয়।’
‘অসাধু তদন্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর বিভাগীয় শাস্তির ব্যবস্থাও রাখতে হবে, যার সুফল দেশের নাগারিকগণ ভোগ করবেন’-মন্তব্য করে দৈনিকটি।
অন্যদিকে, প্রথম আলোর সম্পাদকীয়তে সংশোধিত ফৌজদারি কার্যবিধির কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বেশ কিছু জিজ্ঞাসাও এসেছে। দৈনিকটি বলছে, ‘ভুয়া মামলা থেকে নিরপরাধ মানুষকে পরিত্রাণ দিতে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধনের যে বার্তা দিলেন, সেটা ইতিবাচক। কিন্তু এই উদ্যোগের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এর প্রধান কারণ হলো তদন্তাধীন থাকা অবস্থায় মামলা প্রত্যাহারের বিষয়টি জটিল ও দীর্ঘ প্রক্রিয়া।’
সংশোধিত ফৌজদারি কার্যবিধির দুর্বলতা নিয়ে সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, ‘সংশোধিত ফৌজদারি কার্যবিধিতে বলা আছে, কমিশনার, এসপি বা এসপি পদমর্যাদার কোনো পুলিশ কর্মকর্তা তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীন কোনো মামলার বিষয়ে যদি ‘মনে করেন’, তদন্ত কর্মকর্তার কাছে প্রাথমিক প্রতিবেদন চাওয়া যৌক্তিক, তাহলে তিনি তা চাইতে পারবেন।’
সংশোধিত কার্যবিধিতে আইনি বাধ্যবাধকতার অনুপস্থিতি বিষয় উল্লেখ করে এতে বলা হয়েছে, ‘‘এখানে ‘মনে করার’ বিষয়টি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির (পুলিশ কর্মকর্তা) সম্পূর্ণ ইচ্ছাধীন। তিনি মনে করলে মামলার তদন্ত চলাকালে প্রাথমিক প্রতিবেদন চাইবেন, না মনে করলে চাইবেন না। আইনি বিধান এখানে বাধ্যতামূলক নয়।’’
‘যেভাবেই হোক, মামলার হয়রানি থেকে যেমন নিরপরাধ মানুষ রেহাই দিতে হবে, তেমনি প্রকৃত অপরাধীদের বিচারও নিশ্চিত করতে হবে’- দাবি জানায় দৈনিকটি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ প্রসিকিউটোরিয়াল উপদেষ্টা জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী ফৌজদারি কার্যবিধির সংশোধনীর প্রয়োজনীয়তা ও এর প্রায়োগিক দিক সম্পর্কে বলেন, ‘এই আইনের সংশোধনীর উদ্দেশ্য হচ্ছে যাঁরা নির্দোষ-নিরপরাধ, এমন শত শত আসামি রয়েছে, যারা ভয় বা আতঙ্কের কারণে শঙ্কার মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে তাকে সেবা দেওয়া। সুতরাং যুগোপযোগী এই আইনের মাধ্যমে এই যে ভোগান্তি তা লাঘব হবে।’
‘আমি আশাবাদী অতি অল্প সময়ের মধ্যে গেজেট নোটিফিকেশন হয়ে যাবে। নোটিফিকেশন হয়ে গেলেই আইনের কার্যকারিতা শুরু হয়ে যাবে। আইনের অধীনে ক্ষমতাপ্রাপ্ত যারা রয়েছেন তারা তাদের দায়িত্ব পালনে ভূমিকা রাখবেন। পূর্বের মামলাগুলোর ক্ষেত্রেও এই আইন বলবৎ থাকবে’-বলেন জ্যেষ্ঠ এই আইনজীবী।
মামলার তদন্ত প্রতিবেদন নির্ধারিত সময়ে দিতে ব্যর্থ হলে ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্খা নেওয়া হবে কিনা, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এ বিষয় নিয়ে অনেক সুদূরপ্রসারী আলোচনা হয়েছে। অনেক মিটিং হয়েছে, বিভিন্ন স্টেকহোল্ডাররা ছিলেন।’ আইনের আওতায় অবশ্যই এই বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হবে, মনে করেন তিনি।
ঢালাও মামলাকারীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হবে কিনা-সেই বিষয়ে এডভোকেট এহসানুল হক সমাজী বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘এই জাতীয় মামলাসমূহকে রোধে রাষ্ট্রের খরচ বা অপব্যয়কে রোধ করার জন্য এই সংশোধনটি আনা হয়েছে। তদন্তকারী কর্মকর্তা তদন্তের চূড়ান্ত পর্যায়ে যদি দেখেন যে, পুরো অভিযোগটি হচ্ছে ফলস (মিথ্যা) সেক্ষেত্রে পেনাল কোডে অভিযোগকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রয়েছে। সুতরাং তদন্তকারী কর্মকর্তা স্বচ্ছভাবে নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করবেন। তার ভিত্তিতেই পুলিশ রিপোর্ট সাবমিট করবেন।’
বার্তা২৪.কম-কে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি আরও বলেন, ‘পুলিশ রিপোর্ট সাবমিটের পূর্বে পুলিশ সুপার বা পুলিশ কমিশনারই তদন্ত প্রতিবেদন চাইতে পারেন। এই ক্ষমতা এক্সক্লুসিভলি তাদের দেওয়া হয়েছে। কারণ আপনি জানেন, কোড অব ক্রিমিনাল প্রসেডিংসসের বিধান অনুযায়ী, পুলিশ রিপোর্টস সাবমিট না হওয়া পর্যন্ত লার্নেড ম্যাজিস্ট্রেট বা কোর্ট বিবেচনায় না নেওয়া পর্যন্ত নিরপেক্ষ তদন্তে যাতে কোন প্রভাব না আসে সেজন্য সেই বিধান রাখা হয়নি।’