
সম্পাদকীয়:
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে আদর্শিক অবস্থানের প্রশ্নটি বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ ও বিতর্কিত। বিশেষত, জামায়াতে ইসলামী ও আওয়ামী লীগের সম্পর্ক নিয়ে সাম্প্রতিক আলোচনায় একটি নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে — “জমাত ইসলামের আওয়ামী লীগ প্রীতি”। এই সম্পর্কের বাস্তবতা, সম্ভাব্য কারণ ও এর ভবিষ্যৎ প্রভাব বিশ্লেষণ করা আজ সময়োপযোগী।
জামায়াতে ইসলামীর ইতিহাস মূলত ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে রাজনীতি করাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। এক সময়ে তাদের আদর্শিক অবস্থান ছিল আওয়ামী লীগের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির সম্পূর্ণ বিপরীতে। বিশেষ করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ভূমিকা ও পরবর্তী সময়ের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব তাদের মধ্যে সম্পর্ককে আরও বৈরী করে তোলে। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতার জন্য জামায়াতের অনেক নেতা যুদ্ধাপরাধে দণ্ডিত হন।
তবে বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা এক ভিন্ন চিত্র তুলে ধরছে। বিএনপির সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি জোটের পর, জামায়াত যেন ক্রমশ একটি নতুন কৌশল নির্ধারণে আগ্রহী হচ্ছে। আওয়ামী লীগের প্রতি তাদের কিছুটা নরম মনোভাব প্রকাশ পাচ্ছে বক্তব্যে ও বিভিন্ন অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগে। কেউ কেউ একে রাজনৈতিক সুবিধাবাদ হিসেবে দেখছেন, আবার কেউ বলছেন এটি একটি কৌশলগত পুনর্বিন্যাস।
এখানে প্রশ্ন ওঠে — আদর্শ কি শুধুই কাগুজে, না কি রাজনৈতিক বাস্তবতার মুখে তা নমনীয় হতে বাধ্য? আওয়ামী লীগ ধর্মনিরপেক্ষতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধ্বজাধারী হলেও, বাস্তব রাজনীতিতে নানা সময়ে ধর্মভিত্তিক দল ও গোষ্ঠীর সঙ্গে কৌশলগত সমঝোতা করেছে। অন্যদিকে, জামায়াতও বুঝতে পারছে যে রাজনৈতিক অস্তিত্ব রক্ষা করতে হলে একচ্ছত্র বিএনপি নির্ভরশীলতা পরিহার করা দরকার।
তবে এ সম্পর্ক যদি সত্যিই গভীর হয়, তবে তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য একটি বড় ধাক্কা হতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষের অবস্থানকে ঘোলাটে করে দেওয়া, তরুণ প্রজন্মের মাঝে বিভ্রান্তি ছড়ানো এবং নৈতিক রাজনীতির অবসান ঘটানো — এসবই হতে পারে এই নতুন ‘প্রীতি’র পরিণতি।
শেষত, রাজনীতিতে নমনীয়তা ও কৌশলগত সমঝোতা একটি পরিচিত ব্যাপার হলেও, আদর্শিক অবস্থানের স্থায়িত্ব ও স্বচ্ছতা জনগণের আস্থার প্রধান ভিত্তি। যদি জামায়াতে ইসলামী ও আওয়ামী লীগ সত্যিই কোনো নতুন রাজনৈতিক সমীকরণে এগিয়ে যায়, তবে তা যেন জনগণের স্বার্থ ও দেশের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে হয় — এটাই প্রত্যাশা।