পেঁয়াজ চাষিদের ‘লাভের গুড়’ খাচ্ছে কে?

Spread the love

প্রতিবছর রোজার সময় পেঁয়াজের দাম নিয়ে অস্থিরতা দেখা গেলেও এবার দেখা গেল ব্যতিক্রম। পুরো রোজার মাস পেঁয়াজের দাম নিয়ে ক্রেতারা স্বস্তিতে ছিলেন; কিন্তু বাজার চড়ছে রোজার পর।

চলতি সপ্তাহে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ১০ থেকে ২০ টাকা। অন্যদিকে চাষিদের কেউ-কেউ লোকসানের কথা বলছেন। প্রশ্ন উঠছে, পেঁয়াজ ব্যবসার মুনাফায় পকেট ভরছে কোন পক্ষের?

রোববার রাজধানীর কারওয়ান বাজার, মহাখালী কাঁচাবাজার ঘুরে দেখা গেছে পেঁয়াজ মানভেদে ৫০ থেকে ৬০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। এক সপ্তাহ আগেও যা ছিল ৩৫ থেকে ৪০ টাকা কেজি।
কারওয়ান বাজার কিচেন মার্কেটের বিক্রেতা সবুজের ভাষ্য, “পেঁয়াজ এখন কৃষকের খেত থেকে গেছে হিমাগারে। খেতে যতদিন ছিল, দাম কম ছিল। আর এখন ধরে রেখে দাম বাড়ানো হচ্ছে।”

একই কথা মহাখালী কাঁচাবাজারের বিক্রেতা আল আমীনের। তিনি বললেন, “পেঁয়াজ কৃষকের খেত থেকে উঠে গেছে। এখন কৃষক আর বড় মজুদদারদের কোল্ড স্টোরেজে আছে মজুদ করা। ভারতীয় পেঁয়াজ না ঢুকলে দাম আরও বাড়তে পারে।”
দাম বাড়ার পেছনে মজুদদারি

ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

মাঠ থেকে ওঠার পর কৃষক থেকে শুরু করে পাইকার বা মজুদদার- সবাই পেঁয়াজ মজুদ করছে। মজুদ পেঁয়াজ বাজারে কম আসায় মূলত দাম বাড়ছে, এমনটাই বলছেন মাঠপর্যায়ের কৃষকরা।

সরেজমিন রাজবাড়ীর বিভিন্ন মাঠ ঘুরে দেখা গেছে, চাষিরা পেঁয়াজ জমি থেকে তোলার পর পাট, তিলসহ বিভিন্ন ফসল আবাদ করছেন। মাঠে না থাকলেও চাষিদের ঘরে রয়েছে পেঁয়াজ। যাদের ফলন খুব ভালো হয়েছে, তারাই হাট-বাজারে বিক্রি করছেন।

বুধবার জেলার সদর উপজেলার চন্দনী পেঁয়াজ হাটে চাষিদের মাথা, ভ্যান, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায়, ঘোড়ার গাড়িতে করে পেঁয়াজ আনতে দেখা গেছে। এসব পেঁয়াজ মান ভেদে প্রতি মণ ১৮০০ থেকে ২ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সপ্তাহের ব্যবধানে মণ প্রতি ৪০০-৫০০ টাকা বাড়ায় খুশি চাষিরা।

পেঁয়াজের মৌসুম শেষ না হতেই কেন বাড়ছে দাম- এমন প্রশ্নে চন্দনী গ্রামের পেঁয়াজ চাষি আফজাল হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঈদের আগে প্রতি মণ পেঁয়াজ বিক্রি করেছি ১১০০ থেকে ১২০০ টাকা। তখন পেঁয়াজ ছিল কাঁচা। অল্পতেই এক মণ হয়ে যেত। এখন পেঁয়াজ শুকিয়ে গেছে যে কারণে পরিমাণে বেশি লাগছে।

“তাছাড়া আমরা যারা চাষি আছি, তারা যার যতটুকু জায়গা ঘরে আছে, সেখানে সংরক্ষণ করে রাখছি। যেন সুবিধা মত সময়ে বেশি দামে বিক্রি করতে পারি। যে কারণে বাজারে আমদানি কম হচ্ছে। আরেকটি কারণ হল ‘মজুদ পার্টি’ নেমে পড়েছে। তারা যে দাম পাচ্ছে সেই দামেই কিনে নিয়ে চলে যাচ্ছে। যে কারণে পেঁয়াজের দাম বাড়ছে।”

ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

সুলাইমান প্রামাণিক নামের আরেকজনও বললেন একই কথা।
তিনি বলেন, “দাম বাড়ার প্রধান কারণ হল কাঁচা পেঁয়াজ এখন বাজারে নাই। কৃষকেরা পর্যাপ্ত পরিমাণে তাদের বাড়িতে পেঁয়াজ মজুত করে রেখেছে। যে কারণে বাজারে আমদানি কম হচ্ছে। তাছাড়া বড়-বড় ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজ কিনে স্টক করে রাখার জন্য নামছে। বাজারে আমদানি কম হওয়ায় তারা বাজারে যে দামে পাচ্ছে সেই দামেই কিনে নিয়ে যাচ্ছে।”

চন্দনী বাজারের পেঁয়াজ ব্যবসায়ী মতিউর রহমান মুন্না বললেন, “মাঠে এখন পেঁয়াজ নেই। চাষিরা পেঁয়াজ সবাই বাড়িতে রাখছে। বাজারে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম হচ্ছে। যেখানে পাঁচশ মণ পেঁয়াজ দরকার সেখানে পেঁয়াজ আমদানি হচ্ছে তিনশ মণ। যে কারণে দাম বেড়ে যাচ্ছে।”

দাম বাড়ার তথ্য মিলেছে ঝিনাইদহ জেলা থেকেও। জেলার শৈলকুপা উপজেলার মনোহরপুর গ্রামের চাষি মো. নুরুজ্জামান পাপ্পু বলেন, এবার ১৫ বিঘাতে পেঁয়াজ চাষ করেছেন। প্রথম দিকে ১৪৫০ টাকা মণ দরে ১০০ মণ বিক্রি করেছেন। বাকি পেঁয়াজ মজুদ করে রেখেছেন; পরে বিক্রি করবেন।

শৈলকুপা উপজেলার ভাটবাড়িয়া গ্রামের শামসুল ইসলাম বলেন, “আড়াই বিঘা জমিতে পেঁয়াজ চাষ করেছি। প্রায় দুইশ মন পেঁয়াজ হয়েছে। একশ মণ মজুদ করেছি। পরে বিক্রি করব।”
আবাদে খরচ কেমন

ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

কৃষকদের দেওয়া তথ্য অনু

যায়ী, প্রতি বিঘা জমিতে জায়গা ভেদে পেঁয়াজ চাষে গড়ে ৫০ থেকে ৭০ হাজার টাকা খরচ হয়। তবে, জমি ইজারা নিয়ে চাষ করলে খরচ বেশি পড়ে।

নাটোরের নলডাঙ্গার পাটুল এলাকার কৃষক রুবেল আহমেদ বলেন, “পুকার (পোকা) যে উৎপাদন, পিঁয়াজে দুই দিন পরপরই ওষুধ দেওয়া লাগে। জমি লিজ লিতেই (নিতে) এখন ৩০ থেকে ৫০ হাজার টেকা লাগবে। ৫৫ থেকে ৬০ হাজার টাকার জমিও আছে। এক বিঘা মাটিত ৯ থেকে ১০ কেজি বিচি লাগে। ৫ হাজার টেকা কেজি এখন (অন্য সময় দুই আড়াই হাজার টাকা কেজি)।

“লিজের ৫০ হাজার টাকা প্রথম চান্সে দিলেন। এরপর চারা, চাষবাষ হাবিজাবি (সার ও কীটনাশাক) ৩০-৪০ হাজার ধরেন। চারা লাগাতে ধরেন ১২ হাজার টাকার কামলা ল্যাগবি। এক বিঘা মাটিত যদি ৬০ মুণ (মণ) পিঁয়াজ হয়, প্রতি মুণে খরচ হয় ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার টেকা। পিঁয়াজ উটার (ওঠা) পরে দাম গেছে হাজার ১২ শ টেকা। মুড়িকাটা ৫ থেকে ৬০০ টাকায়ও বিক্রি হই। এখন বাজার একটু বেশি (১৫০০-২০০০), কিন্তু দাম হওয়া লাগবি ৪-৫ হাজার টেকা মুণ।”

নলডাঙ্গার ঠাকুর লক্ষ্মীকুল এলাকার কৃষক জহুরুল ইসলাম বলেন, “এক বিঘা জমি (পেঁয়াজ) লাগাতে-তুলতে ২৩ হাজার টাকা ল্যাগবি। ওষুধে ২০ হাজার টাকা খরচ যায়। ৪৩ হাজার; আর খায় খালাসি জমি যদি ৩০ হাজার টাকা বিঘা জমি লিচ্চে। এক আবাদে সেটি ১৫ হাজার ধরেন। তাইলে দুই কম ৬০ হচ্চে। এরকমই ৬০-৭০ হাজার টাকা খরচ যায়।”


Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *